মোহজাল (পর্ব: ছয়) - Women Words

মোহজাল (পর্ব: ছয়)

অনন্যা হক

এই যে মোমেনা বললো,কাদের ওকে খুব ভালবাসতো,তাহলে ফুলি কে দেখেই ভালবাসা কি হাওয়া হয়ে যেতে পারে?মাধবী ভাবে, আসলে ভালবাসা কি এমন হয়?

নিজেই বলে,কখনও না।সুখে দুঃখে পাশে না থাকতে পারলে কি তাকে ভালবাসা বলে, সেটা হলো মোহ।মোহ কেটে যেতে বেশি সময় লাগে না।কাদের মোমেনা কে কখনও ভালবাসেনি।সে একটা মোহজালে আটকে ছিল,ফুলিকে দেখে,ফুলির সঙ্গ পেয়ে সেই মোহ কেটে গিয়েছিল।

এমন লোক ফুলির মোহও বেশি দিন ধরে রাখতে পারবে না হয়তো।

মোমেনা কে জিজ্ঞাসা করে মাধবী, তুই ঘরে ঢুকে এই দৃশ্য দেখে চুপ করে ফিরে এলি,কিছু না বলে?

-না, সেদিন আর চুপ করে বসে থাকিনি।ঘরের ভিতরে ঢুকে ফুলিরে বিছানা থেকে হাত ধরে উঠায়ে এক থাপ্পড় মারছি।সিরাজের বাপ বুঝে উঠার আগে চুল ধরে ধাক্কায় উঠোনে নামাইছি।

ঐ দিন আমার শরীরে অসুর ভর করছিল।

শাশুড়ি হৈ হৈ করে ছুটে আসে আমার কাছ থেকে ছাড়ায় নিয়ে তার ঘরে নিয়ে উঠায়।

-তোর বর ঘরে বসে থাকলো?ভয় পাইছিল নাকি?

-ভয়? সে বের হয়ে আসে আমার মুখে এক চড় মারলো। শাশুড়ি

ভাইজি রে ঘরে থুয়ে আমার মরণ দেখতি বার হলো।আমি তো তার মুখির দিক তাকায় থাকলাম,করে কি এই লোক,এত বড় অপরাধ ধরা পড়েও এমন সাহস?

ঐ বুড়ি কয়,কত বড় সাহস, আমার ভাইজির গায়ে হাত দেয়।

এরপরে কি হলো ঐ মানুষটার, লজ্জা শরমের মাথা খায়ে মারে কলো, আমি ফুলি রে বিয়ে করবো।

আমি তো চিৎকার দিয়ে উঠলাম, কও কি তুমি, এত বড় সর্বনাশ করতি আমি দেব না তোমারে।আল্লাহর দোহাই লাগে সিরাজের বাপ, তুমি হুশ ফিরায় আনো।তোমার উপর শয়তান আছর করছে।

আমারে তো আবার মারতে আসে।শাশুড়ি কয়,তুই পুরুষ মানুষ গায় গতরে খাটবি, দুই তিন বিয়ে তে বারণ নেই তো।আমি বুঝলাম আসল শয়তানি কার,সে তার ভাইজিরে নিখরচায় গতি করার তাল খুঁজছিল।

আমি সিরাজের বাপ রে হাত ধরে কলাম, তুমি ঘরে চল,আমার কথা শোন আগে,তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? সে ঝামটা মারে হাত ছুটায় কয়, সর চোখের সামনে তে।

সিরাজের বাপ, তোমার দুডো ছেলে আছে,ওগের মুখের দিকে তাকাও তুমি।কয়,নাটক থামা।

এরপরে হনহন করে তার মার ঘরে গিয়ে ফুলিরে হাত ধরে বের করে আনলো। আমার চোখের সামনে দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিল।

আমি ঐ জায়গায় ঘরের দোরে বসে পড়লাম। আসরের আজান শেষ হলো,বেলা পশ্চিম দিকে তখন যায় যায়।আমি কূল কিনারা করতি পারছি নে কই নিয়ে গেল হাত ধরে।

এর মধ্যি ঐ বুড়ি কয়, যা রাতের ভাত চুলায় দে।একেবারে পাষাণী, ডাইনি একটা। শরীরে কোন মায়ার ছিটে নেই।যেমন মা, তেমন ব্যাটা।এতদিন বুঝি নাই।

নতুন একটা মায়ে মানুষ বাড়ি তে না ঢুকলি এই চেহারা বুঝতাম না আপা।

রাগ,ক্ষোভ, ঘৃণা যেন মোমেনার ভেতরে নতুন করে আগুন জ্বালিয়ে দিল।সে তার আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।জীবনের তাগিদে সব ভেতরে ধারণ করে দিন যাপন করে চলেছে এতদিন।

বলতে থাকে, আমি আমার ঘরের ডোয়ায় বসে থাকলাম ঝিম ধরে।বেলা পড়ে আবার নামাজের সময় হলো।

দেখি ভর সন্ধ্যায় ফুলিরে সাথে নিয়ে বাড়ি ঢুকলো।আমার পাশ দিয়ে গটগট করে আমার ঘরে উঠে গিল।

ওর মা তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকলো।কানে শুনলাম মারে কলো,সাক্ষী সাবুদ নিয়ে বিয়ে করে আসলাম।

শাশুড়ি আবার বের হয়ে আমারে কয়,উঠিস না কেন,যা চুলা ধরা, ভাত চুলায় দে।

কিসের ভাত,আমি কি ওগের কেনা দাসী নাকি? সেদিন ঐ লোক টারে ঠিক একটা শয়তানের নাহাল লাগছিল আমার কাছে।আমি আস্তে করে উঠে ছেলে দুডোরে সাথে কোরে ধানের ঘরে খিল দিয়ে পাটি পাড়ে ওদের ঘুম পাড়ায় শুয়ে থাকলাম।

কিছুক্ষণ পরে আবার বারান্দায় এসে বসলাম।সে আমার চোখের সামনে ভাত খায়ে ফুলিরে নিয়ে ঘরে দোর দিল।বসে আছি উল্টো ঘরের বারান্দায়, আমি যে একটা মানুষ না ভুত পেত্নি, সিরাজের বাপ ফিরেও তাকালো না।

সবাই যার যার দরজা দিল,অন্ধকারে বসে থাকলাম। রান্না ঘরের বারান্দায় একটা কুপি জ্বলতিছিল,বাতাসের ঝাপটায় নিভে গিল।

আমার সাত বছরের সংসার একদম আন্ধার হয়ে গিল আপা।

আমার ঘরের ভিতর তে ফুলির হাসি কানে আসে বাজলো।

আমার বুকের ভিতর তখন হাতুড়ি পেটা চলতিছিল।

ঘরের পাশে বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে একটা কুক পাখির ডাক কানে আসতিই কেমন একটা ভয় ধরলো,উঠে ঘরে যায়ে খিল দিয়ে শুয়ে পড়লাম।সারা রাত চোখের পাতা এক করতি পারিনি।চোখের পানিতি কষ্ট ধুইছি।

এরপরে ভোর বেলা ওরা উঠার আগে,ছেলে দুটোরে সাথে করে ওদের বাড়ির তে বের হয়ে আইছি।

ওরা ভাবছিল গরীব ঘরের মায়ে যা খুশি তাই করলিও ঘর ছাড়ে যাবিনে।

আমারে তো তালাক দেয় নাই।আমি ঐ যে আইছি আর ঐ বাড়ি মুখো হইনি।আমার মা আমারে বুঝছিল।কইছিলাম আমি সতীনের ঘর করবো না।

এরপরে এই আপনার জিম্মায় রাখে গিল।

ছেলে দুডোর টানে আমারে একবার ফিরায় নিতি আইছিল, আমি তার সামনেই যাইনি।

আমার সাত বছরের সংসার কেমন করে অন্যের দখলে চলে গিল।

এই সংসার আর এমন হওয়ার সুযোগ নেই।দেখি এবার কপালে কি লেখা আছে।

মাধবীর আর কথা বলার কিছু থাকে না।

বলে, যা এবার,আমি একটু বিশ্রাম করবো।মোমেনা উঠে চলে গেল।মাধবী নতুন করে ভাবতে থাকলো ওকে নিয়ে।মোমেনার মনের গহীনের কষ্ট মাধবী কে স্পর্শ করে গেল।

চলবে…

আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

মোহজাল (পর্ব:পাঁচ)