অনন্যা হক
আজ সাত দিন হলো ছেলে পক্ষ দেখে গিয়েছে, কিন্তু কোন খবর জানায়নি। এই বাড়ির সবার মন খারাপ কিন্তু জামিলার কোন ভাবের পরিবর্তন নেই। সংসারের কাজ করে নতুন উদ্যমে, তেমনই ঘুরে ফিরে বেড়ায়।
মায়ের মন খারাপ, প্রতি দিন স্বামী কে জিজ্ঞাসা করে। আজও খাবার সময় জানতে চায়, ওরা কোন খবর দিছে?
আজ ধমক মেরে ওঠে লোকটা, আর কোন কথা নেই তোমার? একই কথা প্রতিদিন বল, খবর দিলে জানতে না?
দাদি পাশে থেকে বলে, রাগিস কেন, মা এর মন তো, সম্বন্ধটা ভাল ছিল। চিন্তা তো আমারও হয়।
এবার জামিলার আব্বা বলে, মেয়ে কি আমার বোঝা হয়ে গেছে মা? এক জায়গায় বিয়ে হয়নি,সবুর কর। আরও ঘর আসবে। খেতে দাও ভাত গুলো ঠিক মত। যদিও লোকটাও কিছুটা আশাহত হয়েছে।
আজ খাওয়ার পরে দাদি জামিলার ঘরে যায়, গিয়ে দেখে সে মোবাইলে খুব হেসে হেসে কার সাথে কথা বলছে।দাদিকে দেখেই জামিলা বলে, পরে কথা বলবো, বলেই কেটে দেয় লাইনটা।
দাদি বলে, কার সাথে কথা বলছিলি, এত খুশির ঝিলিক চেহারায়?
রেবেকার সাথে দাদি, কেমন আছে শ্বশুর বাড়ি, বর কেমন, আচরণ, ব্যবহার কেমন, এসবই আর কি।
তো কাটলি কেন লাইনটা, আমারে একটু দিতি, একটু কথা বলতাম, কতদিন দেখিনা মেয়েটা কে!
পরে বোলো দাদি, আমি এখন ঘুমাবো।দাদি বলে, ঘুমা, যাই আমি ঘরে।
দাদি ভাবে, মন ভাল থাকলেই ভাল, কি এমন বয়স! কেবলই তো এক ঘর দেখলো। আবার এও ভাবে, এ কেমন মেয়েরে বাবা, কোন মাথা ব্যাথাই নেই এসব নিয়ে। ভাল, এমন হওয়াই ভাল, বুদ্ধি বেশি না কম বুঝতে পারে না।
এদিকে মিজানের পরিবার বাড়ি ফিরে গিয়ে আলোচনা করে, এখানে আর আগানো যাবে না। তার মায়ের একই কথা, সাথে বোনেরও, পরিবারের একই কথা-ছেলের বউ ফর্সা হতে হবে।
মিজান এখন কোন কথা বলে না কিন্তু তার মনে জামিলা উঁকি ঝুঁকি মারছে। সে ঠিক করে, এখনই বাড়িতে কিছু বলবে না, আগে মোবাইলে মেয়েটা কে বুঝে নেই, পরে বাড়িতে রাজি করাবে।
রাতে যখন ঘরে একা হয় মিজান, আগে নম্বরটা সেভ করে মোবাইলে, তারপরে ফোন দেয়।
জামিলাও তার ঘরে একা এখন, কিছুতেই ঘুম আসে না, ফোনের অপেক্ষাই করছে। ফোনটা বেজে ওঠে, রাত বেশি বলে শব্দ কমিয়ে রেখেছিল, যেন পাশের ঘরে দাদির ঘুম না ভাঙে। মনই বলে দেয়, সেই মানুষটা, লাফ দিয়ে উঠে বসে।একটা অচেনা নম্বর। বলে হ্যালো, কে বলছেন?
ওপাশ থেকে বলে,কেন নম্বর টা যে দিয়ে দিলে, অন্য কারো অপেক্ষায় ছিলে নাকি?
না না, অন্য কে আমাকে ফোন করবে, আমি জানতাম আপনি ফোন করবেন, তাই তো জেগে আছি।তবুও আপনার নাম বলেন, আমি তো আপনার গলা চিনি না।
আমি মিজান, আজ তোমারে দেখতে গিয়েছিলাম।তোমার অনেক বুদ্ধি, তারিফ না করে পারছি না।
তাই বুঝি, শুধু বুদ্ধির কথা বলছেন যে, এবার বলেন তো, আমারে পছন্দ হইছে কিনা!
এখনই বলবো কেন, তুমি না বললে,কথা হলো আসল, কয়েক দিন কথা বলে, তারপর বিয়েতে মত দিব?
বিয়ের কথা কে বলছে? আমিও তো এখনও মত দেইনি।শুধু জানতে চাইছি, আমারে ভাল লাগছে কিনা।বিয়ে না হয়, নাই হলো।
মিজান ভাবে, এ তো সত্যিই তাজ্জব মেয়ে, মিজান একটু করে কথায় মজতে থাকে।সে বলে, এবার বল তো, আমারে তোমার ভাল লাগছে কিনা।
জামিলা খিল খিল করে হেসে ওঠে, মুখে হাত চাপা দেয়, এত রাতে আবার কেউ শুনে না ফেলে।বলে আপনি খুব চালাক।সত্যি কথা হলো, লেগেছে, তাই তো নম্বরটা দিলাম। নইলে দেই একটা পর পুরুষ কে? বলে, কেন আপনার সাহস নেই, সত্যি কথা বলার, পছন্দ না হলে বলে দেন না, কাল থেকে আর কথা বলবো না, অযথা কথা বাড়িয়ে কি লাভ?
মিজান এবার ফাঁপরে পড়ে যায়। ভাবে বাড়িতে সবাই মত দেয়নি, এত আগে কি বলবে ভেবে পায় না।কিন্তু মেয়েটাকে তার ভাল লাগতে শুরু করে।বলে, অনেক রাত হয়েছে। আজ ঘুমাও কাল বলবো।
পরের দিন মিজান মায়ের কাছে গিয়ে বসে।মা রান্না করছিল। মা বলে কিরে কিছু বলবি, নাকি ভাত খাবি?
মিজান বলে, মা একটা কথা বলি মনোযোগ দিয়ে শুনো।মা একটু ঘাবড়ে যায়, কি বলবে ছেলে কি জানি।
বলে, মা একটা মেয়েকে শুধু কালো বলে বাদ দিয়ে দিলে? এইটা কি ঠিক করলে মা? মেয়ের তো অন্য কত কিছু থাকতে পারে ভাল।
ও এই কথা, তুই কি জানিস?
না মা, আমি খোঁজ নিছি ভাল করে আশেপাশে, মেয়েটা ভাল।
আসল কথা হলো, তারে আমার ভাল লাগছে, চেহারায় বুদ্ধির ঝিলিক আছে।শোন এই বুদ্ধিই হলো আসল, বুদ্ধিমতী মেয়ে বিয়ে করলে বংশধর ভাল হয়। রাজি হয়ে যাও মা।
এত তাড়াতাড়ি বুদ্ধির কি দেখলি তুই, কথা বলেছিস? আর তোর বুবুও তো রাজি না।
রাখ তো মা বুবুর কথা। তার গায়ের রঙ টা কি, দুলাভাই তাকে বিয়ে করেনি?
এবার মা বোঝে, লেখা পড়া জানা বুদ্ধিমান ছেলে, তার সাথে কথায় এটে উঠতে পারবে না।এ ছাড়া প্রতিষ্ঠিত ছেলে, এত কি বিরোধিতা করা যায়। না পেরে বলে,ঠিক আছে, তোর বাপের সাথে কথা বলে নেই, বুঝতে পারছি, মনে ধরছে তোর।
মিজান উঠে যায় মায়ের কাছ থেকে, বুঝতে পারে, একটা সবুজ সংকেত পেল। কিছুটা খুশি মনে ঘরে যায়, ভাবে আজ রাতেই জামিলা কে জানাবে, তার মনের কথা।
রাতে আবার ফোন করে,বলে, আজও জেগে আছ, আমার জন্য শুধু?
কে বলছে আপনার জন্য? আমি এমনিতেই দেরি করে ঘুমাই।
তোমার এর আগে কাউকে ভাল লাগেনি?
জামিলা বলে এইটা জেনে কি করবেন আপনি, আমারে যাচাই করছেন? পছন্দ করছিল একটা ছেলে, এই গ্রামেরই। অনেক দিন জ্বালাইছে, এখন সরে পড়ছে।ছেলেটা হলো ক্যাবলা, বোকার হদ্দ, আমি বোকা মানুষ পছন্দ করিনা। আমার কিন্তু কালো রং কোনদিন পছন্দ না, যদিও আমি কালো,কিন্তু আপনারে দেখে চেহারায় বুদ্ধি দেখছি, তাই ভাল লাগছে।
এবার মিজানের প্রচন্ড হাসি পায়, হেসেও দেয় জোরে।জামিলার সত্যবাদিতা তার ভাল লাগে। এবার মিজান বলে, তোমারে আমার খুব পছন্দ, খুশি এবার?
বললে না সেদিন, কয়েক দিন কথা বলে মত দিতে, এভাবে আর কত দিন কথা বলবো, তারপর আমার বাড়ির লোক যাবে, তোমার বাড়ি পাকা কথা বলতে।
এর পর থেকে তারা প্রতি রাতে দুজনে কথা বলে।কথার জালে দুজনে প্রতি দিন একটু করে আটকে যেতে থাকে।
ঠিক পনেরো দিন পরে ছেলে পক্ষ জানিয়ে দেয়, তাদের মত আছে।তারা পাকা কথা বলতে আসতে চায়।
এ কারণেই জামিলার মুখে বাড়ির কেউ মন খারাপের কোন আঁচড় দখেনি, বরং তাকে আরও অস্থির ,চঞ্চল মনে হয়েছে।
পনেরো দিনের ভেতরে মিজান এর পরিবার এসে,বিয়ের দিন ক্ষণ ঠিক করে যায়।জামিলার পরিবারের সবার মনের সব দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায়। পরিবারে বিয়ের আমেজ শুরু হয়ে গেল।
জামিলার দাদি জামিলাকে বলে, তোর বুদ্ধির কাছে আমি হেরে গেলাম জামিলা।বুঝতে পারলাম এ এই যুগের মেয়ের বাহাদুরি।
গল্পটির পূর্বের দুইটি পর্ব