রমার গৃহপ্রবেশ - Women Words

রমার গৃহপ্রবেশ

রোমেনা লেইস

হলের গেস্ট রুমের পাশে ব্যাগ রেখে হলের  দাদুর কাছে চারটা কয়েন নিয়ে কয়েনবক্সে গেল।কয়েনবক্স  থেকে হৃদয় কে জানালো
-আমি রোকেয়া হলে।বাসা থেকে চলে এসেছি আর যাব না।
-তাই?আমি আসছিG তুমি চিন্তা করো না।
রমার থমথমে গলা শুনে হৃদয় আর দেরী করে না।
রমা হলের গেস্টরুমের সিঁড়ি তেই বসে থাকলো।অপক্ষার প্রহর বরাবরই দীর্ঘ ।
বাবার আদর, মায়ের অভিমানী মুখ, মেজদির গিন্নী গিন্নী ভাব,বড়দি আর বড়দার উপদেশ সব মনে পড়তে লাগলো।
অসহায় রমা। হৃদয়কে কেন সবাই অপছন্দ করছে বুঝে উঠতে পারলো না।

ঘন্টাখানেকের মধ্যে হৃদয় আসলো। ওকে ওর এক বন্ধুর বাসায় নিয়ে গেলো। সেখান থেকে বিকেলবেলা শাওয়ার নিয়ে সেজেগুজে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে নিয়ে গেলো মা, দাদা,মাসি-মেসো সবাই মিলে। মালাবদল আর সিঁদুরের টিপ পড়িয়ে ওকে মাসির মিরপুরের বাসায়নিয়ে গেলো।

-তড়িঘড়ি করে হৃদয়ের বন্ধুরা বাসরঘর সাজালো ফুল দিয়ে। মাসির বাড়িতেই বাসররাত  হলো।বাসর ঘরে রমা বললো
-হৃদয় আমার অনেক কান্না পাচ্ছে ।
-ঠিক আছে কাঁদো।
ওকে বুকের কাছে দুই হাতে জড়িয়ে রাখলো। পাওয়া না পাওয়ার কষ্টে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলো রমা। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো হৃদয়
-আর কেঁদো না মনা।

এভাবেই কেঁদে  কেঁদে ঘুমিয়ে গেল ক্লান্ত রমা। চোখে আলোর ছটা লেগে  ঘুম ভাঙলো। দেখলো হৃদয় ওর মাথায় হাত রেখে ঘুমাচ্ছে।এর চেয়ে পবিত্র আর ভালবাসায় ভরা স্বর্গীয় দৃশ্য কোনদিন দেখেনি রমা।

পরদিন সকালের ফ্লাইটে ওরা যশোর  গেল।কাসার থালায় দুধের মধ্যে আলতা পরা পা ডুবিয়ে, শাঁখ বাজিয়ে উলুধ্বনিতে, মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে সকল কু নাশ করে গৃহলক্ষ্মিকে বরণ করে নিলেন
হৃদয়ের মা অনুরাধা  ব্যানার্জী। বড় দাদার তখনো বিয়ে হয়নি। বাড়ির প্রথম বউ মনোরমা।

পরিমল ব্যানার্জী, হৃদয় এর বাবা। সিভিল সার্জন। প্রণাম করতেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন
-আজ থেকে এই বাড়ির মেয়ে তুমি মা।আমার বাউন্ডুলে ছেলের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে যে উদারতা তুমি দেখিয়েছ তা সত্যি ই সাহসের ব্যাপার। আশীর্বাদ করি সুখি হও। ভয় পেও না। আমি তোমার সাথে আছি।

হৃদয়ের একটা মাত্র ছোটবোন পলা ।বিয়ে হয়ে হাজবেন্ডের সাথে খুলনায় থাকে।সেও  রাতেই আসলো।কালরাত্রি পার হলো।অনুরাধার ঘরে ছোটমাসীসহ পলা আর রমা শুয়েছে। হৃদয় মাথা ব্যথার অজুহাত দেখিয়ে তিনবার এই রুমে আসার চেষ্টা করলো। ছোটমাসি ওকে পাশের ঘরে
নাপা খাইয়ে দিয়ে আসলেন।

ছোটমাসি  মল্লিকা বললেন
– বউমা, তোমার মা অনার্স পাশ  না করলে কোনভাবেই বিয়ে দিতে চান না হৃদয়ের সাথে।তোমার মেজদি বললো, ডাক্তার  ইঞ্জিনীয়ার পিএইচডি পাত্র লাইন দিয়ে আছে। এমন অযোগ্য ছেলের হাতে আমাদের বোনকে তুলে দিতে মা কীভাবে মত দিবেন? একথা জানার পর আমি আর আমার দিদির অপমান হতে দিতে চাইনি। তাই কথা না উঠিয়ে চলে এসেছি। দিদি হীরার আংটি দিয়ে তোমাকে আশীর্বাদ করতেই গিয়েছিলো। তোমার বাড়িতে হৃদয়ের দরজা বন্ধ হলে অসুবিধা নেই কিন্তু এবাড়ির দরজা মানে আমার বোনের মনে আঘাত পেলে এ বাড়ির দরজা তোমার জন্য বন্ধ হোক তা আমি চাইনি।
রমা বুঝতে পারলো কেন বাবার কাছে প্রপোজাল না দিয়ে ই ওরা  সেদিন চলে এসেছিলো। সেদিন রমা মনে মনে মাসির উপর বিরক্ত হয়েছিলো ।এখন ভুল ভাঙলো ।

মহা ধুমধামে বৌভাত অনুষ্ঠান হলো।শহরের সব আত্মীয় বন্ধু বান্ধবকে নিমন্ত্রণ করা হলো।ফুলশয্যার পরম আকাঙ্ক্ষার রাত অবশেষে এলো।যশোরের ঝিকরগাছা থেকে রজনীগন্ধা আর গাঁদা ফুল এনে সাজানো হলো ঘর শয্যা সব। কী এক ব্যথা থেকে থেকে বাজে রমার বুকে।
মুখটা ম্লান হয়ে যায়।বুকটা ফাঁকা হয়ে যায়।
বিকেলের ফ্লাইটে ঢাকা থেকে হৃদয়ের ক্রিকেটার বন্ধুরা আসে।রমাকে দেখে চমকে যায়।
-দোস্ত কী যাদু করলি রে! এযে দেখি সাক্ষাৎ দুর্গা প্রতিমা।
-হৃদয় শুধু হাসে। প্রেমের যাদুমন্ত্ররে দোস্ত ।

বেহিসেবী ভালবাসায় অবগাহন করতে করতে রমার প্রতিনিয়ত মনে হলো জীবন এতো সুন্দর। মায়ের মমতা, পিতার অপরিসীম স্নেহ, বড়ভাইর স্নেহ আর ছোটবোনের আব্দার সর্বোপরি ভালবাসার মানুষের অকৃত্রিম ভালবাসায় রমার জীবন কানায় কানায় পূর্ণ।

ঢাকায় চমৎকার ডুপ্লেক্স বাড়ি কিনলো হৃদয় ।ফুলে ফুলে সে বাড়ি সাজিয়ে গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে মস্ত পার্টি দিলো।একশ পাউন্ড ওজনের মনোরমাকে পাঁজাকোলা করে বিশটি সিঁড়ি ডিঙিয়ে  ঘরে নিয়ে গেল। সত্যি কারের গৃহপ্রবেশ হলো।

কী এক বিষন্নতার বাঁশী বেজে ওঠে।বাবার জন্য মন উতলা হয়।কষ্টে ভরে ওঠে মন।মায়ের সাথে  অভিমান তীব্র হয়। হৃদয়ের সব আছে। সে জাতীয় দলে ক্রিকেট খেলে। দেশের বাইরে যেতে হয়।এ কারণে পরীক্ষা সময় মতো দিতে পারেনি। শুধু এই তার অপরাধ। এই তার অযোগ্যতা। হৃদয় গান গাইতে পারে। তবলা বাজাতে পারে। গমগমে ভয়েস দিয়ে উপস্থাপনা, আবৃত্তি করতে পারে। যে কোন অনুষ্ঠানে সে মধ্যমনি। মানুষকে ভালবাসতে পারে। এগুলো কেউ যাচাই করলো না।

হৃদয় অনার্স  আর মাস্টার্সই শুধু করলো না।বিসিএস দিয়ে শিক্ষা ক্যাডারে যোগ দিলো। এম ফিল করে পিএইচডি করার জন্যও তোড়জোড় করছে।
রমা বুঝে এক ধরনের জেদ কাজ করে ওর ভেতর। হৃদয় রমাকে বলে
-তোমার ভালবাসা আমাকে যে শক্তি দিয়েছে তা আমার জীবনকে পাল্টে দিয়েছে। তুমি যে সাহস দেখিয়েছ তার মর্যাদা আমি ঠিকই রাখবো। তোমার মা যে আক্ষেপ বা দুঃখ করছেন তা অচিরেই ঘুচিয়ে দেবো।

হঠাৎই মনোরমার বাবা একদিন ফোন করলেন।না তখনো মোবাইল আসেনি ল্যান্ড ফোন ই ভরসা।
-মা কেমন আছিস?
— ভাল আছি বাবা। বাবা, তোমরা কেমন আছ? আমাকে ক্ষমা করে দিও বাবা।
–দিয়েছি মা। তোর মা খুব অসুস্থ ।তুই কী আসতে পারবি? তোদের দেখতে চায়।

হৃদয় ওর হাত থেকে ফোন নিয়ে নেয় ওর কান্না ভেজা চোখ দেখে।
-জী বাবা ও কালই যাবে। বলে দেয় হৃদয়।
–বাবা তুমিও এসো। তোমরা দুজনেই এসো। ওরা পরদিন দশটার ফ্লাইটে সিলেট নামলো। মাকে দেখতে গেল হসপিটালে। রমার মার ব্লাড লাগবে। হৄদয়ের সাথে গ্রুপ ম্যাচ হলো।হৃদয় রক্ত দিলো।এবার সুস্থ হয়ে হৃদয় আর মনোরমা দুজনকেই বুকে টেনে নিলেন ভারতী দেবী।
মাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ করলো। ওরা সবাই মিলে ফিরলো ওদের চৌকিদেখির
বাড়িতে । মঙ্গল প্রদীপ আর উলুধ্বনি দিয়ে ওদের বরণ করলো বড়দি আর বৌদি।

 

এই গল্পের প্রথম অংশ

রমার গৃহত্যাগ