বাবার মত হয় না আর কেউ - Women Words

বাবার মত হয় না আর কেউ

রোমেনা লেইস

আমরা বাড়ি ফিরবো যেদিন তার আগে থেকেই আমার আব্বা নিজের পছন্দের মাছ-মাংস সব বাজার করে, রান্না করিয়ে, আমাদের অপেক্ষায় থাকতেন। বাড়ি ফিরলে গেটের কাছেই আব্বা বুকে টেনে নিয়ে বলতেন, বেশী কষ্ট হয়েছে কি? খিদে পেয়েছে? রাস্তায় কী খেয়েছ?
আজ আব্বা নেই। এখন কেউ আর অপেক্ষায়ও থাকে না।।

আমার আব্বা ডাক্তার আবুল লেইস। ডাক নাম ময়না। জন্ম ১৯২৪ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর। বাড়ির পাশের মক্তবে লেখা পড়ায় হাতখড়ি। বড় বোনদের খুব আদরের ভাই। জুবিলী স্কুলে ভর্তি হয়ে ভাল ফলাফল করেন। মেট্রিক পাশ করেন প্রথম বিভাগে লেটার সহ। সিলেট এমসি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন প্রথম বিভাগে লেটার সহ। ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হন। এ সময় আচমকাই আমার দাদা মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর পড়ালেখা চালানো জটিলতায় পড়ে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রফেসর আমার মার মামাত ভাই এর সহায়তায় আমার মা এর সাথে বিয়ে হয়।
মেডিকেল এ পড়ার সুবাদে ৫২ র ভাষা আন্দোলন এর অংশগ্রহণকারী ও প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন আব্বা। বহুবার সেসব ঘটনা আব্বার মুখে শুনেছি।
এক ভাই এর পরে আমরা চারবোন। আব্বা আমাদের ভালবাসতেন নিজের জীবনের চেয়েও বেশী। প্রতিদিন প্রতিমূহুর্ত প্রতিটা কাজে সেই ভালবাসা প্রকাশিত হতো। ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র চাহিদাও যেমন আব্বার চোখ এড়াতো না। বড় চাহিদাও মিটানোর চেষ্টা করতেন। যার যা পছন্দ আব্বার ঠিক মনে থাকতো। এখনকার সব বাবাদের দেখি  নিজের জন্মদিন বা পরিবারের কারো জন্মদিন এমন কী সন্তানের জন্মদিনও মনে থাকে না। কিন্তু আমার আব্বা কখনো ভুলতেন না আমাদের কারো জন্মদিনই। আমাদের প্রাচুর্য ছিলো না। কিন্তু আব্বা আমাদের রাজকন্যার মতই বড় করেছেন।
যে সময় প্লেনে হাতে গোনা কিছু মানুষই যাতায়াত করতো সে সময় আমরা ঢাকা- সিলেট, সিলেট-ঢাকা প্লেনে যাতায়াত করতাম।
ইডেন কলেজে আমি আর আপা বেগম বদরুন্নেছায় পড়তো। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সবসময় বাড়তি টাকাপয়সা দিয়ে রাখতেন।

মহা আনন্দে আব্বার সাথে ঈদ করে রংপুরে ফিরে গেলাম। বিদায়বেলা প্রতিবারের মত আব্বা জড়িয়ে ধরে আদর করে দিলেও ধরে রাখলেন না। আব্বা কী তখনই বুঝে গিয়েছিলেন আব্বা আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন।
২০০৩ এর ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ রাত আব্বার সাথে কথা হলো। হুমায়ুন ভাই(আমার ভাই এর বন্ধু) এর বিদেশী বউ এর বৌভাত খেয়ে এসেছেন।
সেই গল্পও শুনলাম। এই কথা বলাই শেষ কথা বলা। পরদিন রাত দুইটার দিকে আব্বা চলে গেলেন।
আব্বা যখন ঢাকায় আসতেন তখন আমাদের ঈদ মনে হতো। বেবী আইসক্রীম পার্লারে আইসক্রীম আর ঢাকার যতো নামকরা  রেস্টুরেন্টে সবগুলোতে গিয়ে মজাদার খাবার খাওয়া। কোন মিষ্টির দোকানের কোন পদের মিষ্টি বেশী ভাল সব আমাদের বলে বলে টেষ্ট করাতেন।

একবার আমার বড়ছেলের গায়ে জ্বর। জ্বর বেড়ে একশ তিন চার হয়ে যাচ্ছে। তখন খিঁচুনী শুরু হয়ে যায়।
আমি কেঁদে কেটে আকুল।আব্বা পরম মমতায় সারারাত জেগে জ্বর কমানোর জন্য আইস কোন কোন পয়েন্টে কার্যকর বেশী আমাকে শিখিয়ে দেন। আর নিজে জেগে থাকেন রাতভর, আমাকে ঘুমাতে পাঠিয়ে।আসছে ২৩ শে ফেব্রুয়ারি আব্বার চলে যাওয়ার ১৪ বছর হয়ে যাবে।
যাতায়াত ব্যবস্থা এতো খারাপ ছিলো রংপুর থেকে সুনামগন্জ পৌঁছে রাত এগারোটায় আমি আর আব্বাকে দেখতে পেলাম না। এ জীবনে আর কোনোদিন আব্বাকে দেখতে পারবো না। আমি ভেবেছিলাম বুঝি আমি মরেই যাব। মানব জীবন বড় কঠিন আর নিঠুর। আব্বা ছাড়াই চৌদ্দ বছর পরেও বেঁচে আছি দিব্যি। তবে বড় বেশী অনুভব করি আব্বার না থাকাকে।
স্নেহের পরশের জন্য মন বড় আকূল হয়। একটু গা গরম হলে, একটু প্রেশার বাড়লে মনে পড়ে আব্বাকে। বিপদের সামনে কোন চিত্ত চাঞ্চল্য নাই ধীর স্থির। পরম নিশ্চিন্ত থাকার আশ্রয় আমাদের। বড় বেশী মনে হয় এতো কী তাড়া ছিলো যাবার?

আমার আব্বা বাংলা টু ইংলিশ বা ইংলিশ টু বাংলা ডিকশনারির চলমান এনসাইক্লোপডিয়া ছিলেন। যে কোন শব্দের ইংলিশ বা বাংলা অর্থ মুহূর্তের মধ্যে বলে দিতেন। আব্বার ভূগোল বিষয়ে প্রচুর জ্ঞান ছিলো। গ্লোব আর টর্চ দিয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিবারাত্রির সংঘটন আর হ্রাসবৃদ্ধি বুঝিয়ে দিতেন। অন্ধকার রাতে সপ্তর্ষিমণ্ডল, ধ্রুবতারা, স্বাতি, অরুন্ধুতি
সব চিনিয়েছিলেন।
আজ নিজেই দূর আকাশের বুকে তারা হয়ে গেলে। কিন্তু আমাদের চিনিয়ে দিয়ে গেলে না আব্বা কোন তারাটা তুমি। বড় বেশী অসহায় লাগে তুমি ছাড়া এই জগত…