করিমুন্নেসা খাতুন : সুনামগঞ্জের বেগম রোকেয়া - Women Words

করিমুন্নেসা খাতুন : সুনামগঞ্জের বেগম রোকেয়া

romena-lais-women-wordsবেত আর মূর্তার ঝোপে ঘেরা বাড়িটি। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কামারখালি খাল। পশ্চিমবাজারের কাছে সুরমা নদীতে গিয়ে মিশেছে। সুনামগঞ্জের এরকম বাড়িতেই ১৯১৮ সালে জন্ম নেন করিমুন্নেসা খাতুন। আব্বাস আলী তালুকদার ও নূরজাহান খাতুনের প্রথম সন্তান তিনি।

তাঁর মা আর বাবার আগ্রহে পড়ালেখায় হাতেখড়ি হয় প্রথমে বাড়িতেই। পরে বিশেষ অনুমতি নিয়ে ছেলেদের সাথে বাড়ির পাশের মক্তবে। মুসলিম মেয়েরা পড়াশুনা করতে বের হয়নি তখনো। দশহাত শাড়ি পেঁচিয়ে আপাদমস্তক ঢাকা পুটুলীর মত মক্তবে যাওয়া শুরু করলেন। মক্তবের পড়া শেষ হয়ে গেল। মেয়েকে প্রবেশিকা পরীক্ষা কিভাবে পাশ করাবেন- এই চিন্তায় উনার বাবা মা জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শরণাপন্ন হলেন। প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে পড়তেন করিমুন্নেসা খাতুন। তাই বাড়িতে বসে জুবিলীর প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে স্কুলের ছেলেদের চেয়ে ভালো ফলাফল করতেন।

পড়াশুনায় প্রচুর আগ্রহ থাকায় জুবিলী স্কুলের দুই শিক্ষক বাসায় এসে তাঁকে পড়াতেন। জুবিলীর প্রশ্নে বাড়িতেই প্রাক নির্বাচনী ও নির্বাচনী পরীক্ষা দিলেন। আশানুরূপ ফলাফল করায় শিক্ষকরা তাঁর জন্য নিবন্ধন করান। তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষা দিবেন। ১৯৩৩ সাল, সুনামগঞ্জে তখনো কোন কেন্দ্র ছিলো না। ১৯৪০ সাল পর্যন্ত সুনামগঞ্জে কোন কেন্দ্র ছিলো না। আলোচনা সাপেক্ষে ঠিক হলো সিলেট গিয়ে এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের বাসায় থেকে পরীক্ষা দিবেন । সিলেট আর সুনামগঞ্জের মধ্যে কোন সড়ক যোগাযোগ তখনো ছিলো না। যোগাযোগের পথ ছিলো নৌপথ। বড় এক নৌকা ভাড়া করা হলো। সেই নৌকায় একমাসের চাল, ডাল, তেল , লবণ নেয়া হলো। মোরগ কয়েকটা, ডিম,চিড়া,বিস্কুট, মুড়ি, আচার সবই নেয়া হলো। বইপত্র, কাপড়চোপড়, বিছানাপত্রসহ নির্দিষ্ট দিনে তিনি সিলেটের পথে যাত্রা করলেন। পরীক্ষা চললো প্রায় পনের দিন, যেতে আসতে বারোদিন। প্রায় একমাসের সফর।১৯৩৩ সালে প্রবেশিকা পাশ করলেন। আশার অতিরিক্ত ভালো ফলাফল করলেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলেন ১৯৩৫ সালে। ১৯৩৭ সালে বি এ পরীক্ষায় অংশ গ্রহন করে দুই বিষয়ে পরীক্ষা দেয়ার পরে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে আর পরীক্ষা দিতে পারেন নাই ।।

১৯৪০ সালে সতীশ চন্দ্র উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন । ১৯৪৩ সালে আইনজীবি জনাব আবুল হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

সুদীর্ঘ আটত্রিশ বছর এস সি সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সুনামের সাথে শিক্ষকতা করে ১৯৭৮ সালে চাকুরি থেকে অবসর গ্রহন।

দক্ষতা : ঢাকার হোম ইকনমিক্স কলেজ থেকে রান্না বিষয়ে মিসেস ম্যাকেঞ্জি সহ অন্যান্য বিদেশী শিক্ষকদের কাছ থেকে একাধিক বার প্রশিক্ষন গ্রহন করেন। ফলে বিভিন্ন দেশী-বিদেশী রান্না, বেকিং,আচার ,জেলি,মার্মালেড ,মোরব্বা ইত্যাদি তৈরী করায় বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন।

সেলাই এর প্রতি তাঁর বিশেষ ঝোঁক ছিলো। সেলাই এর প্রতিটি শাখা যেমন এ্যামব্রয়ডারি,কুরুশের কাজ ,উলের কাজ – সব গুলো তেই তিনি পারদর্শী ছিলেন। তাঁকে উলের কাজের ‘এনসাইক্লোপিডিয়া’ বলা হতো। সেই সময়ে শিলং এর একটি প্রতিষ্ঠান তাঁর সেলাই এর কাজ পরীক্ষা করে তাঁকে নিডল ওয়ার্ক ডিপ্লোমা প্রদান করে।

বই পড়া তাঁর অন্যতম বিনোদন ছিলো। একটা সময়ে তাঁর ছেলে মেয়েদের সবাই যখন ঢাকায় অথবা বিদেশে অবস্থানরত,তখন নিরিবিলি বাড়ীতে বই ই ছিলো তাঁর একমাত্র সঙ্গী। হার্ট অ্যাটাকে তাঁর মৃত্যু হয়। অ্যাটাকের পূর্ব মুহূর্তেও তিনি বঙ্কিমের বই পাঠরত ছিলেন।

তাঁর দুই পুত্র এবং তিন কন্যা। সকলেই উচ্চ শিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত-

  •  মেজর (অবঃ) ইকবাল হোসেন চৌধুরী– ঢাকা. বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শেষ পর্বে পাঠ কালীন অবস্থায় সেনাবাহীনিতে যোগ দেন । পরবর্তী তে রাজনীতিতে যোগদান করে পর্যায় ক্রমে বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য মন্ত্রী, পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
  • সোহেলা বেগম- অল্প বয়সে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান।
  • দিলারা হাফিজ- (ইতিহাসে অনার্স,এম. এ ,ঢা. বি ) এডুকেশন ক্যাডারে যোগ দিয়ে সর্ব শেষে বাংলাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহা পরিচালক হিসাবে অবসর নেন।
  • মাহবুব হোসেন চৌধুরী– (একাউন্টেন্সি তে অনার্স, মাস্টার্স ,ঢা. বি )  লন্ডন থেকে চার্টার্ড একাউন্টেন্সি পাশ করে কানাডায় স্থায়ী হন।
  • মিনারা হক- ( ফিলোসফি তে অনার্স ,মাস্টার্স. ,ঢা. বি ) ইয়ুথ মিনিষ্ট্রি তে ডিরেক্টর হিসাবে যোগদান করেন ,কিন্তু স্বামীর বদলির চাকুরির জন্য শেষ পর্য্যন্ত চাকুরি ছেড়ে দেন।

করিমুন্নেসা খাতুন সুনামগন্জ শহরে থেকে সন্তানদের সুযোগ্য নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলেছেন। ১৯৮৩ সালে নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, তিনি তৎকালীন গোঁড়া,পশ্চাৎপদ মুসলিম সমাজের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে নিজেকে এবং সেই সঙ্গে তাঁর পরবর্তী প্রজন্মকে আলোর পথে টেনে নিয়ে গেছেন। এ ব্যাপারে অবশ্য তাঁর মা নুরজাহান খাতুন এবং বাবা জনাব আব্বাস আলী তালুকদার দৃঢ় ভূমিকা গ্রহন করেছিলেন। প্রচন্ড বিদ্যোৎসাহী ছিলেন, তাই কোন বাঁধাই তাঁকে পরাভূত করতে পারেনি। তাঁ স্বামী জনাব আবুল হোসেন ছিলেন সমমনা। তাই বিবাহোত্তর জীবনেও তিনি কখনো বাধাগ্রস্থ হননি। তিনি ছিলেন সুনামগঞ্জের প্রথম এবং সম্ভবতঃ সিলেটের তৃতীয় মুসলিম মহিলা ম্যাট্রিকুলেট (এসএসসি উত্তীর্ণ)। একই সঙ্গে সতীশ চন্দ্র বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রথম এবং বহুদিন যাবত একমাত্র মুসলিম মহিলা শিক্ষক।