নাম-মাহাত্ম্য - Women Words

নাম-মাহাত্ম্য

শবনম সুরিতা ডানা

মানুষের নাম দু’ধরনের হয়। এক, যে নাম জিজ্ঞেস করার আগেই মানুষ আন্দাজ করে নেয়। আর দুই, যে ধরনের নাম দশবার জপলেও ঠোঁটের বশ মানতে চায়না। সৌভাগ্যবশত আমি এই দ্বিতীয় দলে পড়ি। এই নামের কাছে আমি আমৃত্যু ঋণী হয়ে থাকব জানি। কেন তা বলছি একটু পরেই।

শোনা যায় আমার জন্মের আগে মা সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘শবনম’ উপন্যাসটি পড়ছিল। এবং আমি জন্মানোর সাথে সাথেই নাম ঠিক করে ফেলেছিল একান্তে আমার নাম কী হবে। আমি অবশ্য এই চব্বিশ বছরের জীবনে এখনও পড়ে উঠতে পারিনি সেই উপন্যাসটি। অথচ আমার জন্মের সময় মায়ের বয়স ছিল ঠিক এটাই। আগামী জন্মদিনে পড়ে নেব ঠিক, কথা দিলাম।

যাই হোক, পরিবারে খানিকটা গণতন্ত্র চর্চার বদভ্যেস থাকার কারণে বাবাও মেয়ের জন্য একখানা নাম ভেবে রেখেছিল। সুরিতা। কোন মানে নেই শব্দটির, কিন্ত একটা সুর-সুর ভাব আছে শব্দটার মধ্যে। অতএব সঙ্গীতপিপাসু বাঙালি জাতির ঘরে জন্মানো মেয়ের জন্য যে এই নাম একেবারে বেখাপ্পা নয়, এটা বিশ্বাস করা বাবার পক্ষে কষ্টকর ছিলনা মোটেও।

কিন্ত ওই গণতন্ত্রের দোহাই। সুতরাং পুরুষ-মহিলার সন্তানের ওপর সমানাধিকারের কথা ভেবে আমার নাম ঠিক হলো “শবনম সুরিতা”। পদবী নেই কারণ ততদিনে নারীবাদী হবার হাওয়া এদেশে বওয়া শুরু হয়ে গেছে। নতুন বইয়ের পাতার গন্ধের মত রহস্যময় একখানা (বা দু’খানা) গোত্রহীন, পিতৃদায়হীন নাম নিয়ে অবশেষে আমি হাসপাতাল থেকে বাড়ি গেলাম।

বাড়ি গিয়ে আবার দেখা সেই গণতন্ত্রের সাথে। ঠাকুমাও নাম ভেবে রেখেছেন। ইচ্ছে ছিল নাম রাখবেন ডায়ানা, প্রাচীন গ্রীক দেবী আর্তেমিসের রোমান সংস্করণ অনুযায়ী। যে দেবী নাকি প্রতি রাতে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন, আর অত্যাচারী পুরুষদের ওপর লেলিয়ে দিতেন তাঁর কথার বাধ্য কুকুরদের। কিন্ত তখন প্রিন্সেস ডায়ানার ঘোর লেগে থাকায় এই নাম আর রাখা হল না। সেই ‘ডায়ানা’-কেই আরেকটু বাঙালি করে আমার ডাকনামরূপে ধার্য হল ‘ডানা’। যদিও আমার এখন রাস্তায় রাস্তায় রাতবিরেতে ঘুরে বেড়াবার পারমিশন নেই। বা গ্রীক দেবীর মত অমন মাংস-চামড়া দেখানো জামাও পরতে দেওয়া হয়না খুব একটা মেয়ে অসভ্য হয়ে যাবার ভয়ে। কিন্ত নামটা রয়েই গেল।

আমার নাম বিষয়ক আফসোস বলতে মাত্র দুটো। ২০১৬ সালে দাঁড়িয়েও পদবীহীন নামকরণ যে একটা যুদ্ধ হতে পারে, তা মনে করিয়ে দেওয়ার মানুষের অভাব নেই দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। রাষ্ট্রসীমান্তে বর্ডার অফিসার থেকে সঙ্গীতানুষ্ঠানের সঞ্চালক- নামের পেছনে বাপের লেজ না জুড়লে সামাজিক কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয় তাদের মনে। তবে এসব নিছক কৌতুক মেনে ভুলে যাই, ভুলতে চেষ্টা অন্তত করি। কিন্ত আমায় সুরিতা বলে কেউ না ডাকার আফসোসটা থেকেই যায়।

এতকিছু বললাম কারণ মানুষ এখনও ভিড়ে মিশে থেকেও আলাদা হবার স্বপ্ন দেখে বলে আমি মানি। এখনও চায় নিজেদের অপূর্ণ স্বপ্ন পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত হতে দেখতে। আমার ঠাকুমা তাঁর সারা জীবনে ঘটে চলা সব অবিচারের বিরুদ্ধে যে সমস্ত কুকুর লেলিয়ে দিতে পারেননি কখনোই, তারই বহিঃপ্রকাশ তিনি আলতো করে করেছিলেন আমার নামকরণে। ঠিক সেভাবেই, আমার নামে লুকিয়ে ছিল বাবার বেসুর হবার, ছন্দপতনের ভয়। মুজতবা আলীর গল্পের মূল চরিত্রকে মা নিজের জীবনে মুখ্য চরিত্ররূপে দেখতে চেয়েই জন্ম দিয়েছিল ‘শবনম’-এর। তাই এতকিছুর পর যখন কেউ শুধুমাত্র আমার নাম শোনবার পরমূহুর্তে নাক সিঁটকোয়, বিরক্তি প্রকাশ করে ‘কঠিন’ নামের কারণে বা বোকা বোকা প্রশ্নে ছেয়ে ফেলে আকাশ-পাতাল, তখন আমি শুধু হাসি। অন্তর্যামীরা যেমন সবজান্তা হাসির জন্য খ্যাত, ঠিক তেমনই একখানা হাসি পায় আমার খুব।

আমি হাসতে থাকি। আর তারা একের পর এক পরিচিত নামের দড়িতে বাঁধতে চায় আমাকে। আশেপাশে এসে ভীড় জমায় স্বপ্না, শাবানা, সালমা, সাহানা-র মত নামেরা। বাদ পড়েনা সাবান বা সালমানও। আর আমি তাদের প্রত্যেকের দিকে চেয়ে শুধু একটাই কথা বলি, আমি এসব নই। আমার ধর্ম কী জানবার জন্য যখন উৎসুক মুখেরা ঘোরাফেরা করে, আমি একই কথা বলি। জন্মাবধি কোন ভাষা আমার সবচেয়ে কাছের আন্দাজ করতে চেয়ে কত প্রশ্নই না আমার প্রদক্ষিণ করেছে, তাঁর ক্ষেত্রেও উত্তরের কোন নড়চড় হয়নি।

আমি এসব কিছুই নই।

আমার নামে গন্ধ নেই, রঙ নেই, ঐশ্বর্য নেই, রূপ নেই।

আছে শুধু সময়।

ইতিহাসের, বর্তমানের আর খুব বেশী করে ভবিষ্যতের সময়।

আর এই সময় একান্তই আমার। আমার গোত্রহীন, পিতৃদায়হীন, লেজবিহীন নামটির মতই।