কেউ একজন আমাকে অনেক ভালোবাসতেন - Women Words

কেউ একজন আমাকে অনেক ভালোবাসতেন

ফাহমিদা খান ঊর্মি

দাদুমণির বড় ছেলের বড় মেয়ে আমি। মানে পরিবারের প্রথম নাতনী। প্রথম হিসেবে স্বভাবতই সবার আলাদা আদর-যত্ন পেয়ে এসেছি জন্মের পর থেকেই। তার উপর জন্মের পর প্রথম তিন বছর পর্যন্ত যেহেতু পরিবারে আমি একমাত্র শিশু ছিলাম সেহেতু সব ব্যাপারে আমাকে নিয়ে তাদের বাড়াবাড়ি ছিল। তবে দাদীর বেলা সেটা যেন বাড়াবাড়ি পর্যায়েরই ছিল। যে বাড়াবাড়িগুলো না করলেও হতো। যেমন ছোটবেলা উনি কখনো আমাকে মাটিতে খেলতে দিতেন না। শুধু তাই নয় দিনে ৫-৬ বার আমার কাপড় বদলে দিতে হত। কয়েক ঘন্টা পরপর কাপড় বদলে দেরী হলে আম্মুকে সে কি বকাঝকা। শরীরে নাকি রোগ জীবাণু বাসা বাঁধবে! উনার কিছুটা মানসিক সমস্যা ছিল। অন্য দশজন মানুষের মত তাই অত বোধ-বুদ্ধি ছিল না। তিনি আমাকে ফ্লোরে চক দিয়ে আঁকাআঁকি শেখাতেন। বেশি শেখাতেন ভূত-পেত্নি আঁকা। যার উপর রাগ হত ভূত/পেত্নি বানিয়ে তার ছবি আঁকতেন। তার সাথে যুদ্ধ খেলতাম আমরা। বন্দুক কিংবা তলোয়ারের ছবি একে আমাকে বলতেন এইবার গুলি কর। সোজা পেটে তলোয়ার ঢুকিয়ে দাও। আমিও বেশ মজা পেতাম।
একবার সারাদিন ধরে বৃষ্টি। বিকেলবেলা একটু হালকা রোদের ঝিলিক। আমাকে কোলে করে বাড়ির সামনে হাঁটতে বেড়িয়েছিলেন। হঠাৎ কাঁদায় পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন। পা মচকে গিয়েছিল তাতে। অথচ আমার গায়ে একটু আঁচড়ও লাগতে দেননি। যদিও তাকে সপ্তাহখানেক বিছানায় পড়ে থাকতে হয়েছিল।
দাদী দেখতে অপরূপা ছিলেন। ফর্সা ছিলেন বলেই হয়তো শ্যামবর্ণ ও কালো গায়ের রঙ যাদের তাদের ততটা পছন্দ করতেন না। অথচ আম্মুকে প্রায়ই বলতেন, ‘আমার শ্যামলা নাতনীরে এত মায়া লাগে কেন? চোখ সরাতেই পারি না। ওরে সব সময় কাজল পরিয়ে রাখবে।’
প্রায়ই ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে লুকিয়ে রাখা বিস্কিট, চকলেট আমাকে খেতে দিতেন।
তিনি দেখতে যেমন সুন্দরী ছিলেন তেমনি ছিলেন স্মার্ট। সবকাজে পটুও ছিলেন। উলের সোয়েটার বুনতেন আমার জন্য।
আমার বয়স যখন ৩ কি ৪ বছর তখন আমরা বাড়ি থেকে ১৬ কি.মি. দূরে জেলা শহরে চলে যাই। ওইখানকার একটা কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হই। তখন থেকে নিয়মিত দেখা হতো না।

২০০১ সাল। আমি তখন নার্সারিতে পড়ি। বয়স পাঁচ কি ছয়। হঠাৎ টেলিফোন আসে, দাদী অসুস্থ। সাথে সাথে আম্মু আব্বু ছোটবোনকে নিয়ে বাড়ি যান। আমার ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। তাই নানুভাইদের কাছে রেখে যান।
স্পষ্ট মনে আছে, দিনটি ছিল ২০০১ সালের ০৮ নভেম্বর। বেশ ভোরে দাদাভাই মোটরসাইকেল নিয়ে হাজির। নানা ভাইয়ের সাথে কি যেন কথা বললেন। নানাভাই বললেন তৈরী হতে। আমরা সবাই বানিয়াচং যাব। একটা গাড়ি ভাড়া করা হল। আমি বায়না ধরলাম দাদাভাইয়ের বাইকে বসে যাব। কিন্তু দাদাভাই নিলেন না। নানুমণি, নানাভাই, ছোটমামা আর আমি রওয়ানা দিলাম। ঘন্টা দেড়েকে পৌঁছালাম বাড়িতে।
গেইটে গাড়ি থেকে নামতেই আগরবাতির গন্ধ নাকে এলো। মনে মনে ভাবলাম আজ তো শবে বরাত না, আর রাতও না! দু’কদম ভেতরে ঢুকতেই দেখি বাড়িভর্তি মানুষ। কোরআনের কোরাস কানে আসছে। দাদীর ঘরে ঢুকতেই দেখি আম্মু মুখে কাপড় চেপে কেঁদে যাচ্ছেন। দাদী বিছানায় ঘুমিয়ে আছেন নির্বাক। তার শরীরটা চাদরে মোড়ানো। মাথার কাছে আগরবাতি জ্বলচে। যোহরের নামাজের পর দাদীকে ধবধবে সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে দেয়া হয়। দেখতে কেমন জানি কোলবালিশের মত লাগছিল। আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় দাদীর মুখটা শেষবারের মত দেখার জন্য। বারবার ভাবছিলাম দাদীর মুখ এভাবে বেঁধে দিলে উনি তো নি:শ্বাস নিতে পারবে না। কিন্তু উনার শ্বাসক্রিয়া যে অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে এবং উনি আর কখনোই নি:শ্বাস নিতে পারবে না সে বোধটুকুন আমার ছিলই না তখন। দাদীকে খিলগড়ায় তুলে আব্বু-চাচ্চুরা কাঁধে করে নিয়ে গেলেন। সেই যে উনি বেরুলেন, আর আসলেন না…!
তখনো কিছুই বুঝে ওঠতে পারিনি। মানুষ কেন মারা যায় কিংবা মারা গেলে কি হয়, এমনকি মারা যাওয়া কি!
আবছা স্মৃতিতে মনে পড়ে কেউ একজন আমাকে ভুত-প্রেত আঁকা শেখাতেন! কেউ একজন সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ করে আমাকে নিয়ে বিস্কিট খেতেন! আমাকে কোলে নিয়ে কেউ একজন পা পিছলে পড়ে গেলেও আমার গায়ে একটু আচড় লাগতে দিতেন না! পরম যত্নে কেউ একজন আমার জন্য সোয়েটার বুনতেন। কেউ একজন আমাকে অনেক অনেক ভালোবাসতেন। যে মানুষটি আজ থেকে ঠিক পনের বছর আগে এই দিনে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। সেই মানুষটিকে আজও আমি অনেক অনেক মিস করি।

লেখকের অন্য লেখা পড়ুন-
এবেলায় পিছু ফিরে…