ব্রেক্সিটঃ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্যাস্ত? - Women Words

ব্রেক্সিটঃ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্যাস্ত?

Moni Women wordsএকটা সময় ছিলো যখন বলা হতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কখনও সূর্যাস্ত হয় না। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো ব্রিটিশ কলোনি। সেই দিন এখন আর নেই। ২৩ জুন, ২০১৬। পৃথিবীর ইতিহাসে একটি বিশেষ দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এই দিনে গণভোটে ব্রিটেনের প্রায় ৫২ শতাংশ (ভোটে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে) মানুষ ব্রিটেনকে ইউরোপিয় ইউনিয়ন ছাড়ার পক্ষে মত দিয়েছে। ইউকে আর ইইউ এ থাকছে না। এর ফলে, অনেক গুলো বিষয় আলোচনায় ও বিবেচনায় আসছে।

প্রথমত, যুক্তরাজ্যের নিজের অখন্ডতা এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। ২০১৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর স্কটল্যান্ড পার্লামেন্টের একটি বিলের পরিপ্রেক্ষিতে স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্যে থাকবে কি না সে বিষয়ে একটি গণভোট হয়েছিল। সেই নির্বাচনে প্রায় ৫৫ ভাগ ভোটার যুক্তরাজ্যের পক্ষে মত দিয়েছিল বলে স্কটল্যান্ড এখনও যুক্তরাজ্যের অংশ। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে থাকার সিদ্ধান্তের বিষয়ে স্কটল্যান্ড পার্লামেন্টের একটি অংশ আগে থেকেই হুমকি দিয়ে রেখেছে যে যদি যুক্তরাজ্য ইইউ এ না থাকে তাহলে স্কটল্যান্ডও নতুন করে স্বাধীনতার কথা ভাববে। আজ ২৪ জুন সকালে নর্দান আয়ারল্যান্ডের ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার সিন ফেইন দুই আয়ারল্যান্ডকে একত্রিত করার জন্য গনভোটের আয়োজন করার আহ্বান জানিয়েছেন। পরোক্ষভাবে নর্দান আয়ারল্যান্ডও যুক্তরাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হবার আভাস দিচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, গণভোটের ফলাফল প্রকাশের পরপরই প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এ বছরের অক্টোবরের মধ্যেই পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। এটি খুব বেশি বিস্ময়ের ছিলো না। কেননা, পুরো গণভোটের আয়োজনই ছিল ক্যামেরনের রাজনীতির চাল। ২০১৩ সালে ইইউ বিষয়ে গণভোটের প্রতিশ্রুতি দিয়েই তিনি পুনরায় ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ক্যামেরন বরাবরই ইইউ এ থাকার পক্ষে ছিলেন এবং তিনি ভেবেছিলেন যে যদি এই গণভোট ইইউ এর পক্ষে যায় তাহলে তিনি রাজনীতিতে এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর সকল ব্যর্থতা কাটিয়ে নতুনভাবে শুরু করতে পারবেন। তা আর হলো না। এখন, নতুন করে যুক্তরাজ্য নেতৃত্ব সংকটে পড়ছে। ইইউ তে থাকার পক্ষের অনেকের মতেই যারা যুক্তরাজ্যকে ইইউ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ক্যাম্পেইন করেছেন তারা মূলত ইউরোপের চলমান ও সাম্প্রতিক রিফিউজি সমস্যাকে কেন্দ্র করে ভয় ও ঘৃণা ছড়িয়েছেন। সে কথা সত্য হলে, আগামী দিনগুলোতে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে পারে।

তৃতীয়ত, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্তিত্ব সংকট শুরু হতে যাচ্ছে। ১৯৫৮ সালের রোম চুক্তির মাধ্যমে যে উদ্যোগের সূচনা হয়েছিল তা বর্তমান ইউরোপীয় ইউনিয়নের রুপ নেয় ১৯৯৩ সালের ম্যাসস্ট্রিট চুক্তির মাধ্যমে। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ২৮। ইইউ এর সদস্যের মধ্যে অনেকগুলো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা রয়েছে। পূর্ব ইউরোপিয়ান দেশগুলো যখন ইইউ তে যোগ দেয় তখন এ সমস্যাগুলো আরও প্রকট হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের গ্রীস ও ইতালির অর্থনৈতিক বিপর্যয়ও ইইউ এর কার্যকারিতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। অর্থনৈতিকভাবে গতিশীল ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো গ্রীস ও ইতালির মতো স্থবির অর্থনীতির দায়ভার নিতে চায় নি। সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে রিফিউজি সমস্যা। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার অনেক দেশের চলমান সহিংসতা ও যুদ্ধাবস্থার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়েই অবৈধ পথে ইউরোপে পাড়ি দিয়েছে ভালোভাবে বেঁচে থাকার আশায়। কিন্তু, এ সকল অসহায় রিফিউজিদের কীভাবে আশ্রয় দেয়া যায় আর কীভাবেই বা ঠেকানো যায় তা নিয়ে ইইউ এর নেতাদের মধ্যে মতৈক্য ছিলো না। যুক্তরাজ্য মোটা দাগে এই সকল রিফিউজিদের আশ্রয়ের বিপক্ষেই ছিলো। এসবের মাঝে এখন যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে চলে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডও ভাবছে থাকবে কি না। ইইউ এ জার্মানীর আধিপত্য মানতে চাইছে না অন্য অনেক সদস্য রাষ্ট্রই। অনেকে এর মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির চালও দেখতে পাচ্ছেন। সব মিলিয়ে ইইউ এর ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত।

চতুর্থত, যুক্তরাজ্য ইইউ এ থাকলে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে নাকি লাভবান হবে তা নিয়ে গত ছয় মাসে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কঠিন অর্থনৈতিক বিষয়গুলো বাদ দিয়ে সাদামাটা ভাবে চিন্তা করলেও কিছু বিষয় চলে আসে। ঐতিহ্যগত ভাবে যুক্তরাজ্য ভিন্ন মত, ভিন্ন ধর্ম ও ভিন্ন সংস্কৃতি লালন করেছে। এখন এই গণভোটের মাধ্যমে প্রমাণ হলো ব্রিটেনের বেশিরভাগ লোক এখন আর মাল্টিকালচার বা ইন্টারন্যাশনালিজমে বিশ্বাস রাখতে পারছে না। এতো বছর ধরে ইউরোপ জুড়ে ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যেও যে সাদৃশ্য তৈরি হয়েছে তা এখন আবারও বিভাজনে রুপ নিলো। ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেক শিক্ষার্থীরাই যুক্তরাজ্যে শিক্ষা গ্রহণ করতে আসে। এই গণভোটের ফলে, ইউরোপের অনেকেই এখানে শিক্ষা গ্রহণ করতে আসতে দ্বিধাবোধ করবে। আর যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি অনেকটাই এই শিক্ষা-ব্যবসার উপর নির্ভর করে। তাই, এর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা থেকে যাচ্ছে।

পঞ্চমত, সারা পৃথিবীতে একতার শক্তি দিন দিন কমে যাচ্ছে, মানুষের সহনশীলতা কমে যাচ্ছে। ভিন্ন মতকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ভিন্ন মতাবলম্বীদের এক পরিচয়ে বা প্লাটফর্মে আনাটাই যেন চ্যালেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে। এভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জয় হতে থাকলে আর একতার পরাজয় হতে থাকলে, বাড়বে শুধু হতাশা। স্বাধীনতা সবাই চায়। তবে যে স্বাধীনতা মানুষের জন্য সহযোগিতা, সহমর্মিতা আর সামগ্রিকভাবে ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে না,নিয়ে আসে শুধু বিভাজন আর মতপার্থক্য, সেই স্বাধীনতা কতটুকু যৌক্তিক?

পরিশেষে বলা যায়, এই বাইরেও ব্রিটিশদের মনস্তাত্ত্বিক অনেক বিষয় আছে। তবে, যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার প্রক্রিয়া সারতে প্রায় ২ বছর লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আইনগত ভাবে এখনও যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট চাইলে ব্রেক্সিটকে রদ করতে পারে, তবে সেই সাহস হয়তো কেউই দেখাবে না। কেননা, সবাই ক্ষমতায় থাকতে চায়। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট স্রোতের বিপরীতে থাকার ঝুঁকি কেউ কি নেবে? যেভাবে ভাঙ্গন চলছে তাতে আগামী দিনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কতটুকুতে সূর্যের আলো আছে তাই হবে আলোচ্য।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
মাহমুদুল হক মনি
শিভেনিং স্কলারশিপে যুক্তরাজ্যের ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ এ ‘গভার্নেন্স ও উন্নয়ন’ বিষয়ে অধ্যয়ন করছেন। তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (প্রশাসন) ক্যাডারের একজন সদস্য।
এ সংক্রান্ত অন্যান্য খবর
ইউই’র সাথে ৪৩ বছরের বন্ধন ছিন্ন হচ্ছে ব্রিটেনের
পদত্যাগ করছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী
গণভোটের ফলাফল: স্বাধীনতা দিবস নাকি দুর্যোগের লক্ষণ
ব্রিটেনের বিদায়: এবার আত্মসমালোচনার পালা ইইউ’র