রোমেনা লেইস
স্কুলবেলা ভূগোল বইয়ের মাধ্যমে প্রথম শুনেছিলাম নায়াগ্রা জলপ্রপাতের নাম। এটি যে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ জলপ্রপাত তাও সে সময় জানা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সীমানায় অবস্থান এটির। তিনটি জলপ্রপাত মিলে নায়াগ্রা। এরমধ্যে দুটো যুক্তরাষ্ট্রে অন্যটি কানাডায়।
দ্য স্টেট অব নিউইয়র্ক এর বাফেলো সীমান্তে পড়েছে দুটি ফলস। আর কানাডার অন্টারিও প্রভিন্সে পড়েছে একটি ফলস। হর্স সু ফলস কানাডা সাইডে আর আমেরিকান সাইডে পড়েছে আমেরিকান ফলস আর ব্রাইডাল ভেইল ফলস। নায়াগ্রা ফলসের সমস্ত জল বয়ে নিয়ে আসে লেক অন্টারিও আর লেক এ্যারী। তারপর প্রায় একশ সত্তর ফুট উপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া জলরাশিই তৈরি করে এক অনুপম সৌন্দর্য। না কোন পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্নাধারা নয়। আস্ত একটা বিশাল নদী আচমকাই একশ সত্তর ফুট উপর থেকে নেমে গেছে। সারাদিন ধরে দেখেও তৃষ্ণা মেটে না। অবিরাম বয়ে চলা সেই জলের যেন ক্লান্তি নেই।
পাথরের চূর্ণ জলে মিশে আছে বলে এর জল নাকি গাঢ় সবুজ রংয়ের। ২০১১ সালে প্রথম কানাডার টরন্টো গিয়ে দেখেছিলাম নায়াগ্রা ফলস। সেবারও সারাদিন কেটে গেল জলের শব্দ শুনে আর প্রপাতের বিশালতা অনুভব করে। মহান সৃষ্টিকর্তার কী অপূর্ব সৃস্টি!
বারো হাজার বছর পূর্বে এই নায়াগ্রা ফল্সের জন্ম। প্রথম বরফযুগের বরফগলে লেক এ্যারী তে এসে পড়ে, সেখান থেকে নায়াগ্রা রিভার, নায়াগ্রা রিভার থেকে লেক ওন্টারিও তারপর নীচে নেমে যায় সেন্ট লরেন্স রিভারে আর এভাবেই জলের বুকে জল গড়াতে গড়াতে এক সময় সাগরে যেয়ে মিশে যায়।
আমেরিকান সাইডে দুটি আইল্যান্ড আছে। লুনা আইল্যান্ড আর গোট আইল্যান্ড। আমেরিকান ফলস আর ব্রাইডাল ভেইলের মধ্যে এই আইল্যান্ড দুটি অবস্থিত । নায়াগ্রা ফলস থেকে প্রতি সেকেন্ডে পঁচাত্তর হাজার গ্যালন পানি প্রবাহিত হয়। নায়াগ্রা ফলস তার সৌন্দর্য আর হাইড্রইলেকট্রিক পাওয়ারের জন্য বিশ্বে সুপরিচিত। ‘মেইড অব দ্যা মিস্ট’ নামের বোট ট্রীপ আর ‘কেইভ অব দ্যা উইন্ডস’ এর অন্যতম আকর্ষণ। পর্যটকদের জন্য রয়েছে আরো আকর্ষণ। তবে বোট ট্রীপ ‘মেইড অব দ্যা মিষ্ট ‘ খুব বেশী থ্রিলিং। প্রথমবার জলরাশির সৌন্দর্য দেখেই আমি মুগ্ধ। আর কিছু দেখতে যাইনি। তবে দ্বিতীয়বার কানাডা সাইডের বোট ট্রীপে যাই লাল রেইনকোট গায়ে দিয়ে। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কেটে এলিভেটরে করে নীচে বোট ডকে নিয়ে গেল আমাদের। বোটে ওঠার পর মাইক্রোফোনে সবাইকে নিরাপদ থাকার জন্য কিছু পরামর্শ দিয়ে যাত্রা শুরু হলো। হর্স সু ফলস ‘এর কাছাকাছি যেতেই সবাই একসাথে আনন্দধ্বনি করে উঠলাম। হোয়াট অ্যা ক্রিয়েশন অব গড! জলের ঝাপটা এসে ভিজিয়ে দেয় সবাইকে। ক্যামেরার ল্যান্সে পানি পড়ে ছবি ঝাপসা হয়ে উঠলো। তাতে কী? মনের ক্যামেরায় যে দৃশ্য বন্দী করলাম তাতো রয়েই যাবে আজীবন।
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু শাকিলা আযম বুলা দুইবছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের মাল্টিপল ভিসা পেয়েছে। জানালো সে ছেলেসহ আসছে। আরেক বন্ধু শাহনাজ আহমেদ জলি আসার কথা থাকলেও আসতে পারলো না এবার। কথা ছিলো তিনজন মিলে ক্যালিফর্নিয়া যাব। বুলাসহ আমরা পুরা ফ্যামিলী নিউ ইয়র্ক থেকে আলবেনী গেলাম।
আলবেনী নিউইয়র্কের রাজধানী। আমাদের আরেক বন্ধু জাকিয়া নিযাম বিথী ওখানে থাকে। চমৎকার আবহাওয়া। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। ঝকঝকে রোদের ভেতর দুইপাশে সবুজ পাহাড়ে ঝাউ আর পাইনের সারি। গাড়িতে মিউজিক বাজছে কখনো “গাছের পাতা রোদের ঝিকিমিকি” আবার কখনো “আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম…।” কিছুক্ষণ পরপর বিথীর ফোন । আপডেট নিয়ে বলে- চলে আয় তাড়াতাড়ি। আহা কী দারুন হৃদয়ের টান।
তিনঘন্টায় পৌঁছে গেলাম আলবেনী। বন্ধুর গলা জড়িয়ে ধরে চোখ ছলছল হলো! জীবন বড় কঠিন। বুলার বিয়ের দিনে বিথী বুলার মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছিলো সে কথা স্মরণ করে মন ভারাক্রান্ত হয়। ডিউক ভাই অকালেই আকাশের বুকে তারা হয়ে গেলেন । বুলা বুকের কষ্ট গোপন করে একমাত্র ছেলে শান কে নিয়ে দিন কাটাচ্ছে।
বিথী আর ওর ছেলে লালন ‘নির্ভানা ইন্ডিয়ান কুইজিনে’ আমাদের লাঞ্চ করালো। লাঞ্চের পর গেলাম ওদের বাসায়। প্রায় তিরিশ বছর পর দেখা আমার বিথীর সাথে । “আর মাঝে হলো ছাড়াছাড়ি গেলেম কে কোথায় আবার দেখা যদি হলো সখা প্রাণের মাঝে আয়।” ছেড়ে যেতে মন চায় না। কিন্তু বুলার টাইট প্রোগ্রাম। তাই তিনটায় নায়াগ্রার পথে রওয়ানা দিলাম। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম নায়াগ্রা ফলস স্টেট পার্ক যুক্তরাষ্ট্র সাইডে। সন্ধ্যার সোনালী আলোয় দূরন্ত জলের বিশাল জলরাশির সামনে দাঁড়িয়ে বুলা নির্বাক। আমরা হাত ধরাধরি করে বসে থাকি। মনে হয় অনন্তকাল বসে থাকলেও যেন কোন ক্নান্তি আসবে না । অবাক বিষ্ময় নিয়ে শুধু দেখি। ছুটন্ত জলে সোনালী আলোর খেলা। অন্ধকার নামলে চোখের সামনে জলের বুকে নানা রংএর আলোর খেলা। নায়াগ্রা ফলস স্টেট পার্ক বর্ণিল আলোর খেলা দেখিয়ে পর্যটকদের আকর্ষণ আরো বাড়িয়ে চলেছে। অপর পাড়ে কানাডার টরন্টো। ম্যারিয়ট আর ক্যাসিনোর মন ভুলানো হাতছানি। প্রকৃতিতে বিধাতার তৈরি যেসব সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে তার মধ্যে এটি অন্যতম।
রাতের ডিনার সেরে রাত এগারোটা নাগাদ আমরা হোটেলে চলে যাই। হোটেল ডেইজ ইন বাফেলো এয়ারপোর্ট এর কাছে। হোটেলে চেক ইন করে আমার ছেলে স্নিগ্ধ গেল সুইমিং পুলে মেয়ে পূর্ণতাকে নিয়ে। আর আমরা রুমে চলে আসলাম। সারারাত গল্প করব বলে। কিন্তু ক্লান্তি আমাদের ক্ষমা করলো না। ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোরে উঠে শাওয়ার নিয়ে সবাই ব্রেক ফাস্ট করে নিলাম। আজকের আবহাওয়া রিপোর্টে বলছে বৃষ্টি হবে। কিন্তু আকাশ পরিস্কার ছিলো। আমরা সারাদিনের জন্য গাড়ি পার্ক করে নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে লাগলাম। গাছ-গাছালীর ছায়ায় বসে ফল্সের বহমান রূপালি জলের ধারা দেখছি। বোট ট্রীপে শান যেতে চায় না। ‘কেইভ অব দ্যা উইন্ডস’এ যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও লম্বা লাইন দেখে কেউ আর যেতে চায় না। বাচ্চারা ব্রীজ পেরিয়ে গোট আইল্যান্ডএর বোর্ড ওয়াক এ ফলসের কাছাকাছি চলে যায়। ওরা ছবি তুলে ঘুরাঘুরি করে ফিরে আসে প্রায় ঘন্টা খানেক পরে। আমরা প্রাণভরে উপভোগ করি জল প্রপাতের সৌন্দর্য ।
কানাডা সাইডে লাল রেইনকোট আর নিউ ইয়র্ক সাইডে নীল রেইনলকোট পরে পর্যটকরা “মেইড অব দ্যা মিস্ট” এর বোট ট্রীপে ঘুরে আসছে ফলসের নীচে গিয়ে। গা ছমছম করা ভয়ংকর সেই সৌন্দর্য । ‘কেইভ অব দ্যা উইন্ডস’ এ যাবার সাহস সঞ্চয় করে আগামীবার যাব এই আশা রেখে এবারের ভ্রমণ শেষ হলো।
লেখকের আরও লেখা পড়ুন
আমার একটা স্বপ্ন ছিল
জর্জ ওয়াশিংটনের আঙ্গিনায়
তাদের ইংরেজি জানার পরিধি, ‘থ্যাংক ইউ’ পর্যন্ত