চিতায় বসবাস - Women Words

চিতায় বসবাস

সুশান্ত পাল

: কীরে পাগলী! বিয়ের ছবিতে তোকে দেখতে তো পুরো রাজকন্যার মতো লাগছে!
: হয়তোবা! কিন্তু বাবার ঘরের রাজকন্যাটা অন্যঘরে বড় কষ্টে আছে, দাদা।
: মানে?
: কাউকে বলতে পারি না, তোমাকে বলি।
: বল।
: দাদা, তোমার মনে আছে, আমি প্রায়ই বলতাম, ও আমাকে কথায় কথায় শুধু মারে।
: হুম।
: দাদা, তুমি বলেছিলে, ওকে ছেড়ে দে। ওর মধ্যে এটা থাকলে বিয়ের পরেও যাবে না। আমি বিশ্বাস করিনি কখনও, উল্টো তোমার সাথে অভিমান করেছিলাম।
: তুই তো বলতিস, ও তোকে আদর করে গায়ে হাত তোলে।
: হ্যাঁ দাদা। খুব ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইলও করতো। যখন যা ইচ্ছে, তখন তা-ই করতো। তোমাকে বলতাম, মনে আছে, দাদা?
: হ্যাঁ। আমি তোকে বলতাম, সরে আয়। তুই এটা শুনে অনেকদিন কথাও বলিসনি আমার সাথে।
: ঠিক। অন্ধ ছিলাম গো, দাদা। ভাবতাম, সব ঠিক হয়ে যাবে। ভালোবাসতাম যে!
: তো, এখন কী হয়েছে?
: কিছু না, দাদা। সবাইকে যে বলাও যায় না। বাবাকে বলিনি, মা গায়ের কালো কালো দাগ দেখে একটু আঁচ করতে পেরেছে বোধ হয়। আগে শুধু ও-ই মারত, এখন ওর বাবা, মা, এমনকি ছোটবোনও গায়ে হাত তুলে। এইতো সেদিন আমার শ্বশুর চায়ের কাপ ছুঁড়ে মারলেন আমার গায়ে। এমন কোন গালাগালি নেই যেটা আমাকে ওর বোন করে না।
: কী বলিস তুই! ওরা তো অনেক বনেদি বলেছিলি তুই।
: সেতো বটেই। বাইরে থেকে কেউ কিচ্ছু বুঝবে না। ফ্যামিলিতে সবাই খুব উচ্চশিক্ষিত, স্মার্ট।
: আসলেই মারে তোকে? আমার তো কেমন কেমন জানি লাগছে শুনতে। ও ডিএমসি’তে আছে না? ওর বোনটা তো ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে, না? বাবা আগে পিডিবি’র চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছিল বোধ হয়, নাকি?
: সব ঠিক আছে, দাদা। আমি প্রতিদিন নিয়ম করে মার খাই, এটাও ঠিক।
: তুই কিছু বলিস না? তোর বাসায় জানে এটা?
: বাসায় বলিনি এখনও। বিয়ে হল তিন মাস মাত্র। এখন বললে বাবা মরেই যাবে। হার্ট অ্যাটাক হল তো বেশিদিন হয়নি। ডাক্তার বলেছেন, বাবাকে সাবধানে রাখতে। জানো দাদা, সেদিন ওর মা’র সামনেই এত জোরে জোরে ১০-১৫টা চড় মারল যে অজ্ঞানই হয়ে গিয়েছিলাম।
: কী বলছিস এসব! ছিঃ!
: সত্যি কথা বলছি, দাদা। এই মানুষটাই একটা সময়ে জাহাঙ্গীরনগরে গিয়ে পড়ে থাকত শুধু আমার জন্য। এটা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। ও বড্ডো বদলে যাচ্ছে, দাদা।
: তুই এখন কোথায় আছিস?
: আমাদের বাসায় এসেছি দুদিনের জন্য। পাঁচ দিন হয়ে গেল, ওখানে আর যেতে ইচ্ছে করে না। এখানে থাকলে মারের হাত থেকে একটু বাঁচতে তো পারছি। অনেক ব্যথা পাই গো, দাদা। এখন আমাকে দেখলে চিনতে পারবে না। জানো, কালকে ওর মা ফোন করে বললেন, তুই যে ওখানে সুখে বসে আছিস, বাসার কাজগুলো কে করে? এবার আয়, দেখাচ্ছি মজা।
: এই শোন, তুই বাসায় সবকিছু জানা। কেস কর। ওকে ডিভোর্স দে। ওর স্বভাবটা আগে থেকেই ছিল। এটা কখনওই যাবে না রে, শিওর থাকতে পারিস। দিন দিন ও আরও বাজে হয়ে যাবে। ওর বাসায়ও তো সবাই জানোয়ার। তুই ওখানে থাকবি কীভাবে?
: না দাদা, এটা হয় না। ওকে ছাড়া থাকতে পারব না। মরতে মরতেও ওকে ভালোবেসে যাব। মার খেলে গায়ে অনেক ব্যথা পাই, এটা ঠিক। কিন্তু ওকে ছেড়ে এলে যে একেবারে সত্যি সত্যিই মরে যাব। আমি পারব ওকে ভাল করতে। কী দাদা, পারব না?
: কিচ্ছু পারবি না তুই। এ জানোয়ারটা মানুষ হবে না। ওর মধ্যে একটুখানিও মনুষ্যত্ব থাকলে তোর গায়ে হাত তুলতে পারত না। আমাকে আঙ্কেলের নাম্বারটা দে, আমি কথা বলি।
: না দাদা, তোমাকে এসব এমনি এমনিই বললাম। কাউকে বলো না প্লিজ। সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখো।
: তার মানে, তুই ওখানে ফিরে যাবি?
: হ্যাঁ দাদা, যাবো। ওকে ভাল মানুষ করে তুলবো। আমি পারব তো, দাদা?
: যা ইচ্ছা কর গিয়ে! এই শোন, তোকে ওরা খেতেটেতে দেয় তো ঠিকমতো?
: কাজ করলে দেয়। কাজ পছন্দ না হলেও দেয়, তবে সব তরকারি দেয় না। সেদিন আমার ননদ আর শাশুড়ি আমার কবিতার খাতা দুটো পুড়িয়ে ফেলেছে। অনেক কেঁদেছি, দাদা, শোনেনি। তুমি আমার জন্য ভেবো না। নিজের প্রতি খেয়াল রেখো, একটা বিয়ে করো। প্রেম করোনি বলে ভেবো না সুখী হবে না। ও তো আমাকে ভালোবাসত, আর মারত। এখন আর ভালোবাসে না, শুধু মারে। দাদা, জানো কোনোদিন মার না খেলে সেদিন কী যে ভাল লাগে! তখন ওকে শুধু বেশি বেশি ভালবাসতে ইচ্ছে করে!
: তুই আর ও বাড়িতে যাস না রে! তোকে ওরা মেরেই ফেলবে।
: মেরে ফেলবে না, দাদা। মেরে ফেললে মারবে কাকে?
: দেখি, তোর একটা সেলফি তুলে পাঠা। তোকে দেখি।
: ধুউউউরো দাদা, কী যে বলো না! আমি ঠিক আছি, দেখতে হবে না। খুব জোরে মারে নাতো, আমি কাঁদতে শুরু করলে, পায়ে জড়িয়ে ধরলে ছেড়ে দেয়। আচ্ছা দাদা, এসব নিয়ে আর কিছু না বলি, কেমন?
: তুই কবিতা লিখতি না? এখন লিখিসটিখিস তো? অবিকল ভাস্করের মতো লিখিস তুই। তোর সাথে কতদিন কবিতা নিয়ে গল্প করি না! শ্রীজাত পড়েছিলি পরে?
: লিখি দাদা, মনে মনে। কবিতা ছাড়া মানুষ বাঁচে কী করে, বলো! একদিন আমার সব কবিতা ছাপা হবে, চিতার আগুনের শিখায়, এও জানি। কবিতার সবক’টা দুঃখী অক্ষর চারিদিকে ছড়িয়ে যাবে গনগনে আগুনের ফুলকির মতো। সেদিন বোনটাকে একটু আশীর্বাদ করে বলো, অন্তত এখন থেকে ভাল থাকিস। বলবে তো, দাদা?

আর কিছু লিখতে পারলাম না। বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাহাকার করতে লাগল। মনে হতে লাগল, কী যেন হারিয়ে যাচ্ছে কী যেন হারিয়ে যাচ্ছে, আটকাতে পারছি না। আমার ছোটবোন নেই। কোন মেয়ে এমনভাবে কষ্ট পাচ্ছে জানলে সহ্য করতে ভীষণ কষ্ট হয়। প্রায়ই কিছুই করতে পারি না। চোখ ভিজে ওঠে শুধু। যেসব ছেলেরা মেয়েদের গায়ে হাত তোলে, গালাগালি করে, তাদের প্রতি কোন দয়া কিংবা করুণার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ওদেরকে বিয়ে করে ‘ঠিক করার’ কথা মাথায় এনে নিজের জীবনটাকে নরক বানিয়ে ফেলার চাইতে বড় বোকামি আর হয় না। কারণ, এরকম ছেলেরা অবশ্যই মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত, অসুস্থ। একজন অসুস্থ মানসিকতার মানুষের সাথে জীবন কাটিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার তো কোন মানেই হয় না। জীবনের দাম কিছুতেই এত কম নয়!