উৎসব হোক নিরাপদ, বাড়ুক নারীর প্রাণবন্ত অংশগ্রহণ - Women Words

উৎসব হোক নিরাপদ, বাড়ুক নারীর প্রাণবন্ত অংশগ্রহণ

অদিতি দাস
ঘুরে ফিরে আবার চলে এলো বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব বাংলা নববর্ষ। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবারই বাড়তি আগ্রহ থাকে দিনটিকে ঘিরে, থাকে আড়ম্বরপূর্ণভাবে উদযাপনের আকাঙ্খা। কিন্তু নারীর জন্য আসলে কতটা নিরাপদ দিনটি? কতটা আনন্দের? কতটা স্বতঃস্ফুর্তভাবে তারা মিশে যেতে পারেন আবহমান বাংলার এই উৎসবে? আদৌ কি উৎসবকে নির্ভাবনায় উদযাপন করতে পারেন তারা? আর এ দিনটির কথাই বা শুধু বলছি কেন, যেকোন উৎসবের ভিড়, জনসমাগমে কিংবা নির্জন জায়গা– কোথায় নিরাপদ নারী বা কন্যাশিশু?

কতই বা বয়স তখন, বাবার হাত ধরে যেতাম বৈশাখী মেলায়। ভিড়ের মধ্যে টের পেতাম শরীরের যত্রতত্র অবাঞ্চিত স্পর্শ। তখন ছোট ছিলাম বলে বুঝতাম না এ স্পর্শের মানে। বয়স যতই বাড়ল, ততই বুঝতে শিখলাম-এ তো কোন নরপশুর কামনার হাত, আর লোলুপ দৃষ্টি। মনে মনে ভাবি, কি এমন লাভ হয় এ কাজ করে। যারা এরকম হীন মন-মানসিকতা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়  তাদেরকি জন্ম হয়নি কোন মাতৃজঠরে? তারা কি জানে না, এ কাজ করে তারা হয়ে ওঠে কেবলই ঘৃণার পাত্র। এমন কাজ যারা করে তারা হয়তো বা ‘ক্ষণিকের বিকৃত আনন্দ’ লাভের জন্য এমন ঘৃণ্য কাজ করে। তারপর হয়তো সে ভুলে যায় সহজে। কিছুক্ষণ পর আরও কোন মেয়েকে উত্যক্ত করার সুযোগের সন্ধানে থাকে। কিন্তু সে কখনও জানতে পারে না তাঁর মুহূর্তের এই কাজটি একটা মেয়েকে কতটা মানসিকভাবে আঘাত করতে পারে। যার সাথে এ ধরণের অপরাধ সংগঠিত হয়, সে সহজে ভুলতে পারেনা বিষয়টি। তার মনে তীব্র কষ্টের জন্ম হয়, তীব্র অপমানবোধ তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় সারাদিন, কখনও কখনও সপ্তাহ মাস কিংবা তারচেয়েও বেশি সময় ধরে। 

সাধারণত বড় ধরণের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাকে ঘিরেই হয়ে থাকে। তাই বিশেষ দিনগুলোতে সেখানে সমাগত হয় হাজারো মানুষ। আর এই ভিড়কেই লক্ষ্য করে নিপীড়নকারীরা। এমনই এক ঘটনা এখনও আমাদের মানসপটে স্পষ্ট। ২০১৫ সালের ১৪ এপ্রিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। টিএসসি সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকের সামনে কিছু যুবক বাংলা নববর্ষের উৎসবে আসা মেয়েদের শরীরে হাত দিতে থাকে। তখনও চারপাশে বিকেলের আলো ছিল, গেটের ভেতর-বাইরে হাজারো মানুষ। সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়- অনেক নারীর পরনের কাপড় টেনে ছিঁড়ে দেয়া হয়। কারো কারো শাড়ি ধরে টান দেয়া হয়। রিক্সা থেকে টেনে নামানো হয় স্বামীর পাশে বসে থাকা নারীটিকে। অগুণতি মানুষের ভীড়ের ভেতর হারিয়ে যেতে থাকে আক্রান্ত মেয়েদের সাহায্যের আকুতি, চিৎকার। সেদিনের একের পর এক যৌন হামলাকে অনেকেই নজিরবিহীন বলেছেন। ওই ঘটনার পর তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশরা আক্রান্ত নারীদের সহায়তা দিতে পারেননি বলেও অভিযোগ রয়েছে। অবাক করা বিষয় ঘটনার পর পুলিশের দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিরা বলেছিলেন, ‘এটি কতিপয় দুষ্টু ছেলের কাজ’। সাথে সাথে ব্যবস্থা না নেয়ায় সমালোচনার শিকার হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও।

পরবর্তীতে সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখে আটজনকে শনাক্ত করে পুলিশ। তাদেরকে ধরিয়ে দিতে বড় অংকের পুরস্কারও ঘোষণা করে তারা। কিন্তু মাত্র একজন ছাড়া বাকিদের আজও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। ফলে অভিযোগপত্রে নাম এসেছে একজনেরই। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিলেন, সেদিন একাধিক হামলার ঘটনা ঘটে। এই যে বিচারহীনতা, বিচার প্রক্রিয়ার ধীরগতি, এগুলোই পক্ষান্তরে এসব কাজে প্রশ্রয় দিচ্ছে অপরাধীদের। 

টিএসসির এই ঘটনার মত অনেক ঘটনা ঘটছে, অনেক জায়গায় প্রায় নিয়মিত নির্যাতিত হচ্ছেন নারী। সমস্যা হচ্ছে সবক্ষেত্রে নির্যাতিত মেয়েটি স্বাক্ষ্য দিচ্ছেন না। কারণ আমাদের রক্ষণশীল সমাজে এ ধরণের ঘটনার বর্ণণা দেয়া একটা মেয়ের জন্য সহজ নয়। আমাদের অনেকের মধ্যে একটা ধারণা আছে যে, খারাপ মেয়েদের সাথেই যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। কিন্তু এ ধারণাটি মোটেই ঠিক নয়। কমবেশি প্রায় সবাইকেই কোন না কোনভাবে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লজ্জায় বিষয়টি চেপে যান নারী। অথচ লজ্জাতো তাদের হওয়া উচিত, যারা এ ধরণের ঘটনা ঘটায়।       

শিক্ষা কিংবা কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের অবস্থান জোরালো হচ্ছে। তারা স্বনির্ভর হচ্ছেন। তারাও এক শ্রেণীর পুরুষের হামলার শিকার হচ্ছে। নারীদের এই অগ্রবর্তিতা, এই গতিশীলতাকে অনেকক্ষেত্রে মেনে নিতে পারছে না পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। সংসারের খরচ দিনদিন বাড়ছে। পুরুষের একার রোজগারে আর কুলাচ্ছেনা। কিন্তু সেই পুরুষটি যখন ঘরে ফিরছে, তার কোন কাজ করার দরকার পড়ছেনা, কিন্তু নারীটিকে করতে হচ্ছে। এ থেকেই তৈরি হচ্ছে দ্বন্দ্ব। নারীরা বাইরে কাজ করায় সমাজের পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু নতুন পরিবেশে পুরুষ কিভাবে খাপ খাইয়ে নেবে, সে বিষয়ে কোন প্রতিষ্ঠান বা সরকার কোন কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে না।

এই যে পহেলা বৈশাখের মত উৎসবে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ, সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন অনেকেই বিষয়টি পছন্দ করছেন না। অথচ এ ধরণের ঘটনাগুলো শুধু নারীদের উপর আক্রমণ নয়, এটা আমাদের সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যের উপর আক্রমণ। আবার অনেকে চাইছেন না তাদের মেয়ে, স্ত্রী বা বোন এই ধরণের অনুষ্ঠানে যাক। কারণ নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে তারা নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। 

ধর্ষণ কিংবা যৌন নির্যাতনের অনেক ঘটনাই ঘটছে,যার বড় অংশই আমরা জানতে পারছিনা। সবকিছু তো আর গণমাধ্যমে আসছেনা। দেশের আনাচে কানাচে এরকম কত নারী বা মেয়েদের কান্না জড়িয়ে আছে। পাহাড়ে আদিবাসীরা বৈসাবি উৎসব পালন করে, সেখানেও মেয়েদেরকে যৌন নীপিড়ন করার ঘটনা ঘটেছে। আর তা করছে বাঙালি পুরুষরা। আমাদের এই মন মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যেসব পুরুষ এ ধরণের কাজ করে বিকৃত আনন্দ পান তাদের উদ্দেশ্যে বলব, একটিবার চোখ বন্ধ করে ভাবুন- আপনার বোনের সাথে কিংবা স্ত্রীর সাথে কেউ এরকম আচরণ করেছে। আপনার কেমন লাগবে? রক্ত মাথায় উঠে যাবে না? মনে হবে না খুন করে ফেলতে? যে নারীর সাথে আপনি এমন আচরণ করছেন তারও ভাই-বাবা আছেন। তাদেরও একই রকম অনুভূতি হবে। আপনার মতো সেই ব্যক্তিটিরও এরকম মনে হবে। আপনার নিজের বোনটির কথা ভেবে হলেও, সামনে দিয়ে যে মেয়েটি যাচ্ছে তাকে উত্যক্ত না করে সে যাতে নিরাপদে পথ চলতে পারে সেই চেষ্টাটুকু করুন। তাকে মানুষ হিসেবে সম্মান করতে শিখুন। তাহলে শুধু নববর্ষ নয়, সব উৎসব পুরুষদের মতো নারীরাও সমান আনন্দে উদযাপন করতে পারবে। উৎসবের জনারণ্যে কিংবা নির্জন পথেও আর চলতে নারীর সঙ্গি হবে না দ্বিধা, ভয় আর উৎকণ্ঠা। এবারের নববর্ষে এই হোক প্রত্যাশা। আমাদের প্রতিটি দিন, প্রতিটি উৎসব হোক আনন্দের। 

লেখক: সম্পাদক, উইমেন ওয়ার্ডস