তাদের ইংরেজি জানার পরিধি, ‘থ্যাংক ইউ’ পর্যন্ত - Women Words

তাদের ইংরেজি জানার পরিধি, ‘থ্যাংক ইউ’ পর্যন্ত

রোমেনা লেইস
দেশের বাইরে আছি পাঁচ বছর। বাইরে বলতে মার্কিন মুল্লুকে। ২০১৫ এর শুরুতে হঠাৎই দেশে ফেরার চিন্তা মাথায় ঢুকলো। আমার বড় বোন রোকসানা লেইস, তিনি কানাডার মাটিতে পড়ে আছেন প্রায় ষোল বছর হলো। হঠাৎ নাড়ির টান তাকেও ভুগাতে লাগলো। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন ভালো নয়। হরতাল, পেট্রোল বোমা, অভিজিৎ হত্যা সব মিলিয়ে ভীতিকর অবস্থা। শুভাকাঙ্খিদের সবাই মানা করতে লাগলেন। কিন্তু এসব কিছুই আমাদের দমাতে পারল না। সব বাঁধা উপেক্ষা করে আমরা দেশের পথ ধরলাম। প্রথমে আপা দেশে গেলো ।২০ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমীর বইমেলাও যোগ দিলো। আর আমি পরের মাসে অর্থাৎ মার্চে দেশে এলাম।

যেদিন দেশের মাটিতে পা রাখলাম সেদিন ছিল হরতাল। বিদেশী পর্যটক লেখা স্টিকার গাড়িতে সাঁটিয়ে সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর থেকে বাড়ি ফিরতে হলো। দেশে তো ফেরা হলো, এখন মন কত কিছু করতে চায়, কত জায়গায় ঘুরতে। কিন্তু পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে সবাই বারন করতে লাগলেন। যা হোক, পাঁচ বছর পর দেশে ফিরে পরিবর্তন টের পেলাম। সিলেট নগর তো পাল্টেছেই। সেই পরিবর্তনের হাওয়া সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রাম নারায়ণতলায় ও লেগেছে। নিজের জন্ম শহরের পাশে বলে নারায়ণতলা অনেকবার যাওয়া হয়েছে। কিন্তু পাঁচ বছর পর যখন সেই পরিচিত গ্রামে গেলাম, দেখলাম কুঁড়ে ঘর, ছনের ঘরগুলোর জায়গায় টিনের বাড়ি, পাঁকাঘর। দোতলা বাড়িও চোখে পড়লো কয়েকটা। আগে নারীদের শীর্ণ, মলিন আর বাচ্চাদের দেখতাম উদোম গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের নাকে বারো মাসই সর্দির অস্তিত্ব। এবার খেয়াল করলাম নারীরা অনেক সচেতন হয়েছেন, গায়ে তাদের ঝলমলে রঙিন পোষাক। বাচ্চারাও তুলনামূলক পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। আগের মলিন্য নেই। বোঝা গেলো শুধুই পরিসংখ্যানের হিসেবে নয়, বাস্তবেই দেশ এগোচ্ছে। সেই এগিয়ে চলায় নারীরাও আছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। দেশের বাইরে যেতে ও ফেরার সময় তা ভালোই টের পাওয়া যায়।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে খেয়াল করলাম প্রচুর নারী যাত্রীর অস্তিত্ব। তারা যাচ্ছেন লেবানন, আবুধাবী, ওমানসহ বিভিন্ন দেশে। তবে এখানে মন খারাপ করা অভিজ্ঞতাও হয়েছে। প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে এক নারী কাঁদছিলেন অঝোরে। কৌতুহল থেকেই তার সাথে আলাপ জমালাম। তিনি আমাকে একটা গ্রুপ ছবি দেখালেন। তাঁর দুই বছর বয়সী বাচ্চার ছবি সেখানে। জীবিকার টানে কোলের বাচ্চাটিকে রেখে দূরপথে পাড়ি জমাচ্ছেন। স্বামীকে না পাঠিয়ে তিনি যাচ্ছেন কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে বললেন, তাঁর জন্য দালাল পঁচাত্তর হাজার টাকা নিয়েছে। কিন্তু স্বামী যেতে হলে লাগবে এক লাখ পঁচিশ হাজার টাকা। আরো দুই নারীর সাথে কথা হলো বিমানে। তারা গৃহকর্মে সহায়তার কাজ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য যাচ্ছেন। অথচ তাদের ইংরেজি জানার পরিধি, ‘থ্যাংক ইউ’ পর্যন্ত। ইত্তেহাদে যে খাবার দেওয়া হয়েছিল তা খেতে পারছিলেন না তারা। অথচ তারপরও তাদের সাহসী পদক্ষেপ আমাকে মুগ্ধ করলো। আবুধাবী বিমানবন্দরে নেমে দেখলাম বেশ সাবলীল ভাবেই তারা ইমিগ্রেশন পার হলেন। দেশে ফেরার পর ঢাকা থেকে সৈয়দপুর গিয়েছিলাম বেসরকারী বিমানে। তাদের সেবার মান আমার কাছে বেশ ভালো মনে হয়েছে। কোন রকম বাঁধাবিঘ্ন ছাড়াই যথা সময়ে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছে।Girls women words সৈয়দপুর থেকে নীলফামারী যাবার পথে দেখলাম অপূর্ব দৃশ্য। দলে দলে মেয়েরা বাইসাইকেলে চেপে ইপিজেডে যাচ্ছে কর্মস্থলে। আবার কেউ কেউ বইখাতার ব্যাগ নিয়ে স্কুলমুখো। মাত্র পঞ্চাশ মাইল দূরে পায়রাবন্দ গ্রামে বেগম রোকেয়া সংস্কারের আঁধার কাটাতে যে শিক্ষার আলো জ্বালিয়েছিলেন তা যে অনিবার্ণ তা তো এই মেয়েরাই আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন।