হাসির প্রয়াণ - Women Words

হাসির প্রয়াণ

রোমেনা  লেইস

সেদিন  শুক্রবার ।হাসির মায়ের শরীরটা বেশ খারাপ। মা কেন যেন চির রুগ্না।বিছানায় পড়ে থাকেন বেশী।বাসায় পোষা কুকুরটাও থেকে থেকে গলা উঁচু করে কাঁদছে কেন জানি।
-কাঁদিস না ডন কাঁদিস না।চুপ কর চুপ কর।বিছানায় শুয়ে শুয়েই আম্মা বলেন।

ওদের সবার বড়বোনের বিয়ে হয়েছে অনেক বছর।বড়বোন লন্ডনপ্রবাসী।কয়েক বছরে একবার অনেক উপহার নিয়ে বেড়াতে আসেন।মাসখানেক থেকে চলে যান।তবে রানু বুবু নাকি বড় মায়ের মেয়ে।মানে হাসির সৎমায়ের মেয়ে।ওর বাবার দুই বিয়ে। রানুবুবুর মা মারা যাবার পর হাসির মাকে বিয়ে করেন তমিজউদদিন সাব রেজিস্ট্রার ।

বহুবছর দেশে আর রানুবুবু  আসে না।হাসি,মিনু,বীনু তিনবোন।ভাই দুজন।পিঠাপিঠি ভাই কমল।সব ছোট ভাই অভিক। হাসি সবার বড়।

হাসি গোলগাল অপূর্ব সুন্দরী।মায়াবী চেহারা।চুল দেখার মতো, ঘন কালো হাঁটু পর্যন্ত লম্বা।ঠোঁটের বাম পাশে তিল তাঁকে আরও আকর্ষনীয় করেছে।হাসিতে মুক্তো ঝরে।ছোট দুইবোন মিনু,বীনু কমলের ছোট। হাসির খুব সুন্দর গোটাগোটা হাতের লেখা।কলেজে ভর্তি হতেই ছেলেদের চিঠি চিরকুট আসতে লাগলো।সব চিঠিই ডাস্টবিনে ফেলে দেয়।ওর প্রিয় বান্ধবী রোজির সাথে সব বলে হাসাহাসি করে।বাবার ভীষণ আদরের।তাই বাবার অবাধ্য হওয়ার চিন্তাই করে না।ছোটবড় সবার প্রিয় হাসি আপা।

একটা মোটর সাইকেল প্রতিদিন কলেজ থেকে ফেরার সময় রিকশার পেছনে আসে।কয়েকদিন ধরে খেয়াল করে।তারপর একদিন রিকশা থামিয়ে ফেললো।হাতে খাম দিয়ে বলল
-আমার ধৈর্য চ্যুতি ঘটেছে।তুমি উত্তর দাও না কেন?
-আ — আমি …তোতলাতে থাকে হাসি।
-হাতে তুড়ি দিয়ে বলে, দুইদিন সময় ।পরশু ঠিক এই জায়গায় উত্তর দিবা।বুঝছো?
-ভয়ে শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই হাত ইশারায় রিকশা ওয়ালাকে যেতে বললো।
এতো কালো ছেলে!!একী আফ্রিকান নাকি? কী দুধর্ষ ।একদম দস্যুবনহুর এর স্টাইলে
কথা বলে।ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাসায় ফিরলো। আম্মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে হাসি।
-ও পুত কী হলো?সব ঠিক আছে?কাঁদো কেন গো মা?
-না আম্মা।ঠিক আছে।নিজেকে সামলে নেয়।
নিজের ঘরে গিয়ে খাম খুলে বের করলো প্রেমপত্র।পড়তে পড়তে আপণ মনেই রোমাঞ্চিত হয়।তেল কুচকুচে সেই হোন্ডা আরোহীর প্রতি প্রথম দিকে মায়া তারপর মমতা আর সবশেষে প্রেম জন্ম নেয়।

অনেক যোগ্য ছেলের চিঠি ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া সেই হাসি কালা জহিরের প্রেমে আধা মরা হয়ে গেলো।কৃষ্ণ যেমন সুন্দরী রাধাকে পেলো তেমনি মিশমিশে কালো অসুন্দর জহির ও হাসির প্রেম পেলো।গায়ের কালো রঙের জন্য শহরে তাকে সবাই কালা জহির ডাকে।কালা জহির পশ্চিম জার্মানী ফেরত। মাস্তান হিসাবেই সবাই জানে।মারপিটে সবার আগে।কিন্তু গুরুজন দেখলে এমনভাবে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে কথা বলে যে মুরব্বীরা মুগ্ধ।দিনদুনিয়া উঁচু নীচু মান সম্মান সব ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে কালা জহিরের সাথে বিয়ে হয়ে গেলো হাসির।শহরের লোকেরা বলাবলি করলো এ তো বানরের গলায় মুক্তোর হার।বিএ ফেল, বিদেশ ফেরত, শহরের সবার ছিছি করা সেই ছেলের সংসারে হাসিমুখে আলো ছড়ালো হাসি। হাসির বাবা কেনো এই বিয়েতে রাজী হলেন সেটা নিয়ে সবাই মুখ বাকালো।টক অভ দ্যা টাউন এই বিষয়টি।

এক শহরেই শ্বশুর বাড়ি, তাই যখন তখন ভাইবোনেরাও আসে।নিজেও মাকে দেখতে যায়।সুখীই মনে হয়।শাড়ি অলঙ্কারে সাজসজ্জায় বেশ আনন্দিতই থাকে হাসি।
এর মধ্যে লন্ডনে  চলে গেলো জহির। বিরহী হাসি মনের মাধুরী মিশিয়ে চিঠি লিখে।দেখতে দেখতে তিন চার বছর চলে গেলো।ফোনে কথা বলা আর চিঠি পত্র দেয়া নেয়া।ভিতরে ভিতরে অস্থির হলেও প্রকাশ
করে না কখনো।
-তুমি আসবে কবে?মাঝে মাঝে জানতে চায় হাসি।
-আসবো আসবো শিগগিরই ।এখানে একটু ঝামেলা হয়েছে তাই গেলে আর ঢুকতে পারবো না।আমাকে আমার লইয়ার এখন যেতে মানা করেছে।

-আপা দেখ আমার এক বন্ধুর মামা বিলাত থেকে আসছেন। উনি বললেন, দুলাভাই নাকি ওখানে কী সব ঝামেলায় পড়ছেন।উনাকে নাকি পুলিশ খুঁজছে।কমল বললো।
-তুই চুপ কর।বড়দের ব্যাপারে কথা বলতে হয় না।
লন্ডনে বাস করেন এক আত্মীয় তাকে একদিন ফোন করে। কিছু কথা জানতে পেরে একদম চুপচাপ হয়ে গেলো হাসি।ভীষণ উদাসী ।
-ভাবী আসো খাবে না?ননদ ডাকে।
-তোমরা খাও ।আমি পড়ে খাব।দেখা গেলো না খেয়েই কেঁদেকেটে ঘুমিয়ে পড়লো।

এমনি একদিন  ট্রাংক কল আসলো।
-হাসি তুমি বলো দেখি কী জন্য কল করেছি?
-জানি না।
-আমি আসছি দেশে।
-কবে?
-সামনের রবিবার সকাল নয়টায়। ঢাকা এয়ারপোর্টে নামবো।তুমি আসবে ঢাকায় ?
-আচ্ছা। এমনিতেই শান্ত।আরো ধীর শোনায় ওর গলার স্বর।

ঢাকা থেকে এসে অব্দি আত্মীয় স্বজনে বাড়ি ভর্তি।এমনিতেই নানা খবর পেয়ে মনটা বিরূপ হয়েছিলো ।ছোটবোন মিনুর সাথে জহিরের আচরন ভালো লাগলো না। মিনু কলেজে যায়। এবছর পাশ করেছে। শাড়ি পড়েছিলো।ওকে বারবার কাছে টেনে নিচ্ছিলো যা দৃষ্টি কটু লাগলো হাসির কাছে।দুষ্টামীর ছলে মিনুকে ঘনিষ্ট ভাবে ধরতে চাচ্ছিলো।হাসির দৃষ্টি এড়ায়নি। হাসি মিনু বীনুকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো।

রাতে ঘরে যখন দুজন একসাথে হলো।
স্যুটকেস থেকে বোতল বের করে পান করলো কয়ের পেগ।বাধা দিতেই হাসির হাত মোচড়ে দিলো।
-আচ্ছা তুমি এতো বেলেল্লাপনা করছ কেন?
-কী করলাম?
-মিনুর সাথে ওরকম করছিলে কেন?
-তুমি মিনুকে বাড়ি পাঠালে কেন?
-তোমার হাত থেকে বাঁচাতে। এটা কী লন্ডন নাকী?
-মানে কী?
-লন্ডনে যা করছো তা কি এখানে করবে নাকি।
-হাহাহা।আমার টাকা আছে।যা খুশী করবো।আমার যা খুশী তাই করবো। রেখে গেলাম দেশে বিশ বছরের মেয়ে তুইতো এখন চল্লিশ বছরের বুড়ি মনে হচ্ছে। তুই কী করবি?দরকার হলে তোকে তালাক দিযে মিনুকে বিয়ে করবো।আহ মিনু।টসটসে আপেল যেন।
-কী বলো এসব?তুমি কী পাগল?কানে হাত চাপা দেয় হাসি।
একটানে ওর শাড়ি খুলে ফেলে জহির।ব্লাউজের বোতাম খুলতে খুলতে বলে
-না আমি পাগল না।আমার নূতন নূতন মেয়ে চাই।তোকে ভালো লাগে না।কিছুক্ষণ আগে কাছে টেনে নেয়া শরীর টাকে আখের ছিবড়ার মতো থু থু করে ফেলে দিলো দূরে।
অপমানে নীল হয়ে ওঠে হাসির মুখ।

একটা ব্যাগে শ্যাম্পু, সাবান, ক্রীম আর পারফিউম নিয়ে রিকশায় করে কলেজ বান্ধবী রোজির বাসায় গেলো।তখন সাড়ে এগারোটা বাজে।গিফটগুলো ও রোজির হাতে দিলো।রোজি ওর স্কুলের বান্ধবী ।
ওরা সবসময় একসাথে থাকতো।গল্প শেষই হতো না।ক্যামেরাম্যান ডেকে এনে ছবি তুলতো।রোজির তিনবোনকেও হাসি খুব আদর করে।রোজির মা যেন হাসির নিজের আম্মার মতো।খালাম্মার পা ছুঁয়ে সালাম করে।
-খালাম্মা শরীর কেমন?
-আছি গো মা ভালই।এসময় খালু ও আসলেন।
-কীরে মা? কেমন আছ?
-জী খালু ভাল আছি।পা ছুঁয়ে খালা-খালুকে সালাম করে বলে
-আজ আসি আমি।
খালাম্মা বলেন -কিছু মুখে দিয়ে যাও।এরকম খালি মুখে যেতে হয় মা?
-আজ রোজা আছি খালাম্মা।দোষ করলে মাফ করবেন। বলেই রিকশায় উঠলো।-যাই রে রোজি।

শুক্রবারে সাড়ে বারোটায় আজান পড়ে। জুম্মার আজানের আগেই চলে আসলো বাসায়, মায়ের বাসায় ।
-আম্ঁমা ভিঁক্ষা দেঁইন গোঁ।
নাকের এক ফুটাওয়ালা ভিক্ষুক নারীটি এসে ভিক্ষা চায়।ওদের শহরে এই মহিলার নাকের জায়গায় একটা গর্ত।কোন নাক নাই।তাঁকে সব সময় হাসি টাকা দেয়।খেতেও দেয়। হাসির আম্মা বের হয়ে হাসির রুমে দরজা বন্ধ দেখে ডাকেন
-ও হাসি হাসি ভিক্ষা নিতে আসছে ।তুই বিশটাকা দিতে চাইলি যে রে মা।ধাক্কা সত্ত্বেও দরজা খুলে না।দরজা ধাক্কাধাক্কি করে দরজা না খোলায় দরজা ভাঙা হলো।

ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত দেহ নামানো হলো।একটু আগেই প্রাণ পাখী উড়ে গেছে। নিশ্চল স্থির ।শান্ত।প্রাণ হীন দেহ।কোনো অভিমান নাই। অভিযোগ নাই।মাটিতে নামানো হলো লাশ। হ্যা লাশ।এখন আর দেহে প্রাণ নাই।নীরব নিথর।জুম্মার নামাজ শেষে এই খবর শুনে মুসল্লীরা সবাই ছুটলেন হাসিদের বাসার দিকে, হাসির বাবা আর ভাই এর সাথে ।সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা মানুষের মিছিল।

Click here to Reply or Forward