সুলতানা রাজিয়া : ভারতবর্ষে একটি বিস্ফোরণের নাম - Women Words

সুলতানা রাজিয়া : ভারতবর্ষে একটি বিস্ফোরণের নাম

সৌরভ দাস

সুলতানা রাজিয়া ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী নাম। তবে তাঁর নামের আগে “সুলতানা” না হয়ে “সুলতান” হলেই বোধ হয় তা ব্যাকরণসিদ্ধ হতো। কারণ সুলতান শব্দটি ইউনিসেক্স (নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য)। মহিলা বোঝানোর জন্য ব্যাকরণের নিয়ম ভেঙে রাজিয়াকে “সুলতান রাজিয়া” না বলে “সুলতানা রাজিয়া” বলার রেওয়াজটিই ইতিহাসের পথ বেয়ে চলে আসছে।

সুলতানা রাজিয়ার বাবা ইলতুৎমিশ ছিলেন দিল্লির সুলতান। ইলতুৎমিশের পুরো নাম ছিলো শামস- উদ- দীন ইলতুৎমিশ। ইলতুৎমিশ বেশ দক্ষ একজন শাসক ছিলেন। বিভিন্ন অঞ্চলের বিক্ষোভ, বিদ্রোহ দমন করে তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্তই দিল্লীর সিংহাসনে আসীন ছিলেন। মৃত্যুর আগে নিজের উত্তরাধিকারী মনোনয়নের বিষয় আসলে সুলতান ইলতুৎমিশ চিন্তায় পড়ে যান। কারণ ইতোমধ্যে তাঁর বড় ছেলে নাসিরুদ্দিন মাহমুদ মারা গেছে। বাকি যে দুই ছেলে আছে তাদের কেউই সিংহাসনে বসার যোগ্য না। তাহলে কি করবেন ইলতুৎমিশ? সিংহাসন নিজ বংশের বাইরের কারো হাতে সমর্পন করা কোনো ভাবেই তার মন মানতে পারছে না। তখনই ইলতুৎমিশের ভাবনায় আসলো তার জ্যেষ্ঠ মেয়ে রাজিয়ার কথা। রাজিয়া বেশ বুদ্ধিমতী, চৌকষ, যুদ্ধ কৌশলও বেশ ভালো জানে। সর্বোপরি একটি রাষ্ট্র পরিচালনা করার যথেষ্ট পরিমাণ গুণ রাজিয়ার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু সমস্যা তো এক জায়গায়। তাহলে ইলতুৎমিশ কী জবাব দিবেন উলেমাদের কাছে? কী জবাব দিবেন তৎকালীন ইসলামী মতাদর্শে বিশ্বাসী মানুষদের? অনেক চিন্তা করে ইলতুৎমিশ রাজিয়াকেই উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনয়ন দেন। সৃষ্টি করেন পর্দার ভেতর আটকে পড়া এবং গৃহ কর্মে আবদ্ধ থাকা নারী জাতির মধ্যে এক বিস্ফোরণের!

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, ইলতুৎমিশের মৃত্যুর পর আদৌ রাজিয়া ক্ষমতায় বসবে কিনা এ নিয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার হওয়া শুরু করে। একজন নারীর আদেশ সবাইকে মানতে হবে! এটা কী করে সম্ভব? এ প্রশ্ন রাজ প্রসাদের আনাচে কানাচে তখন ঘুর ঘুর করছিলো। পুরো উলেমা সম্প্রদায় রাজিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলো। অভিজাতদের একটি বড় অংশও রাজিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করলো। এমনকি রাজিয়ার মা সহ পুরো পরিবার তার বিপরীতে চলে যায়। সিংহাসনে রাজিয়ার পরিবর্তে বসে ইলতুৎমিশের দ্বিতীয় পুত্র রুকনউদ্দিন ফিরোজ শাহ।

রাজিয়ার কাছেও এটা পরিষ্কার ছিলো যে, কী কারনে তাকে সিংহাসনে বসতে দেয়া হয় নি। কিন্তু রাজিয়া মোটেই দমে গেলেন না। সব সময় চোখ কান খোলা রাখতেন নিজের অধিকার আদায়ের জন্য। স্বভাবতই রুকনউদ্দিন ফিরোজ শাহের অদক্ষ শাসনে অল্প সময়েই তার বিরোধীদের সংখ্যা বেড়ে গেলো। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহার করে একতরফা বিলাসিতায় গা ভাসালেন রুকনউদ্দিন ফিরোজ শাহ। এসব কারণে বিশেষ করে অভিজাতদের অনেকেই তার উপর ভরসা হারালেন। রাজিয়া বেশ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে অভিজাতদের একত্রিত করে রুকনউদ্দিন ফিরোজ শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সক্ষম হন।

সিংহাসনে বসেন রাজিয়া। সুলতানা রাজিয়া। সুলতান আমলে দিল্লীর সিংহাসনে বসা প্রথম এবং একমাত্র নারী। সুলতানা রাজিয়া বেরিয়ে আসলেন পর্দার ভেতর থেকে। পুরুষরা যেরকম রাজার পোশাক পড়ে সিংহাসনে বসতো রাজিয়াও সেরকম পোশাক পরিধান করতেন। যখন বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নর কিংবা অন্য কোনো বিরোধী শক্তি ষড়যন্ত্র কষতো দিল্লী দখলের, রাজিয়া তা বেশ কৌশলের সাথে মোকাবিলা করতেন। যুদ্ধ লাগলে একেবারে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন পুরো বাহিনীর। অর্থাৎ নারীরা যে কোনো অংশেই পুরুষের চেয়ে কম নয় এ সত্য তৎকালীন সমাজে রাজিয়া প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন।

সুলতানা রাজিয়া সাড়ে তিন বছরেরও বেশি সময় দিল্লীর সিংহাসনে আসীন ছিলেন। সময়টা কম হলেও তৎকালীন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে ভারতবর্ষে রাজিয়ার শাসন কাল একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তবে এটা সত্য, শাসন ক্ষমতায় আসলেও একজন নারী বলে তাকে নিয়ে যে বিতর্কগুলো ছিলো সেগুলো কিন্তু তখনো অব্যাহত ছিলো। তবে অনেকটা আড়ালে। এভাবে একজন রাজিয়া নয়, একজন নারীকে সিংহাসন থেকে নামানোর চক্রান্ত প্রতিনিয়ত অব্যাহত ছিলো। এরকম নানান ষড়যন্ত্রের একটি অংশ ছিলো চল্লিশ জন ক্রীতদাসদের সমন্বয়ে গঠিত “চল্লিশ চক্র”। এই চল্লিশ চক্রের বিদ্রোহের মুখেই প্রাণ দিতে হয় রাজিয়াকে।

সর্বোপরি ভারতবর্ষের নারী সমাজের অধিকার আদায়ের নক্ষত্র হিসেবে আজো জ্বল জ্বল করে জ্বলছে সুলতানা রাজিয়ার নাম।