সব আনন্দ ম্লান করে দেয় ভূমিপুত্র টুডুর রক্তাক্ত চোখ - Women Words

সব আনন্দ ম্লান করে দেয় ভূমিপুত্র টুডুর রক্তাক্ত চোখ

রীমা দাস

প্রতি জন্মতিথির মতো এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এবারও তিনি আমাকে ব্যথিত করে গেলেন। তিনি আমার মন খারাপের অনুভূতি। প্রতি জন্মদিনে আমার মন খুব খারাপ থাকে। কেন! তা আমি নিজেও জানি না। এই অনুভূতির জন্য আমি বিব্রত থাকি। হাজারটা সমস্যার মাঝেও মুখে একচিলতে হাসি ধরে রাখতে ভুল করি না কখনও অথচ এই দিনটি আমায় বেদনায় মুড়ে রাখে। সময়ের পরিভ্রমণ মনে করিয়ে দেয় আমি সেই চিরন্তন সত্যের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি।

একটা সময় ছিলো যখন আমি খুব রাগ করতাম কষ্ট পেতাম আমার মা, বোন, বন্ধুরা যদি এই বিশেষ দিনটি ভুলে যেতো কোন কারণে। অথচ প্রথম কিছু নতুন অনুভূতির সাথে পরিচিত হলাম। এবারই প্রথম মনে হল, আমার আনন্দ উদযাপন উচিত নয়। আসলে আমার কোনো কিছুই করা উচিত নয়। নিজের ভেতর কিছু পাপবোধ কাজ করছিল। এবারই প্রথম আমি মনেপ্রাণে চেয়েছিলাম কেউ আমাকে ‘wish’ না করুক। সেই চিন্তা থেকে ফেসবুকে আমার জন্ম তারিখটা ‘hide’ করে রেখেছিলাম।

রাত ১২টা বাজতেই নীল যখন আমাকে ফুল, মোমবাতি আর কেক দিয়ে শুভেচ্ছা জানালো তখন আনন্দের বদলে আমার মনে পড়ে গেল, দ্বিজেন টুডুর কথা। আর আমরা তখন অন্ধকারে নিমজ্জিত সংখ্যালঘুদের কথা ভাবলাম, আমাদের শরীরে যে সিল দেওয়া হলো তার কথা বললাম আর আমাদের অক্ষম আর্তনাদগুলো ছড়িয়ে দিলাম রাতের আকাশে। আমার ভেতরে অপরাধবোধ কাজ করছিলো, আমি আনন্দ করছি অথচ আমার সমগোত্রীয়, আমার ভাই টুডু আহত চোখে, হাতে বেড়ি বাধা অবস্থায় পড়ে আছে হাসপাতালের বিছানায়!! সেই আহত লাল চোখ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

সারারাত সেই দুটি চোখ আমাকে ঘুমাতে দেয়নি। আমি নিজেকে মানুষ মনে করতাম, আমার ভেতরে মানবিক সব বোধের উপস্থিতি টের পেতাম। কিন্তু হায়! আমি তো মানুষ না। রাষ্ট্র আমাকে মানুষের বাইরে সংখ্যালঘু করে দিল!!! এ যে কি যন্ত্রণার, তা শুধু ভুক্তভোগীরাই বুঝে।

মানুষের নির্লিপ্ততা আমাকে ভাবাচ্ছে, কাঁদাচ্ছে। আমি কোনভাবেই কোন আনন্দে অংশ নিতে পারছিলাম না। নীল আমার পছন্দের ফুল দিয়ে খুশী করার চেষ্টা করল, সকালে বাবা-মা-ভাই-শিউলি আর গুলটি র স্নেহ ভালোবাসার আলিঙ্গন আমাকে বাঁধলো। সময় যত গড়ালো প্রাপ্তির খাতায় যোগ হতে থাকলো আনন্দের হিরা-চুনী-পান্না। নীল ঘাস ফুলগুলো হীরার মত জ্বলজ্বল করছে হৃদাকাশে। তবু মনের ভেতর সারাক্ষণ একটা চাপা যন্ত্রণা আমাকে শান্তি দিচ্ছিল না। সন্ধ্যায় প্রাণের সংগঠন কথাকলির উষ্ণ আয়োজনে আমি মুগ্ধ। সারাদিন কাছের, প্রাণের বন্ধুদের আন্তরিক শুভেচ্ছায় আমি সিক্ত হলাম। অথচ আমি খুবই সামান্য একজন। এত এত ভালোবাসা পাবার যোগ্য আমি না, তবু পেয়ে যাই, সেই ভালোবাসায় প্লাবিত হই আমি। আমি ঋণী তাদের কাছে যারা আমাকে শুভেচ্ছা আর ভালোবাসায় জড়িয়ে রেখেছেন। তবুও কোথায় যেন ছন্দপতন! কোথায় যেন হাহাকার!! সব আনন্দ ম্লান হয়ে যায় ভূমিপুত্র টুডুর রক্তাক্ত চোখ মনের আয়নায় ভেসে উঠলে, সাঁওতালদের অসহায় অবস্থার কথা পড়লেই। আমিও তো হতে চেয়েছিলাম জীবনের জলাশয়ে তুমুল রোহিত- কিন্তু জলাশয়টা যে আমার নয় তা জানতাম না বা ভুলে গিয়েছিলাম। এই কথাটি যখনই মনে হয় তখনই বুকের শ্বাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। এই সব দেখব বলেই কি থাকলাম জলাশয়ে??

মরুঝড় থেকে বাঁচার জন্য সবাই(!) বালিতে মুখ গুঁজে রেখেছে। কেউ কল্পনায় ডুবে থাকতে চাইছে, কেউ গর্তে লুকাচ্ছে আর কেউ মাতাল হচ্ছে মদ/ কবিতা বা উৎকর্ষের জন্য। তবু প্রবাহমান ঘটনার প্রতিরোধ হচ্ছে না। সত্য ঘটনাকে কাঁটাছেঁড়া করে তার ভেতর অসত্যকে বসানোর পায়তারা চলছে, চলছে মিথ্যার বেসাতি। গুটিকয়েক লোক বলছে ভালো হচ্ছে না, এসব ভালো হচ্ছে না। সে সংখ্যা নেহাত কম। সব দেখে দেশ থেকে, জীবন থেকে পালাতে চায় মন। তখনই আমার দ্বৈত সত্ত্বা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মত বলে ওঠে- যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব? নিজেকেই প্রশ্ন করি- কেন যাব?? দেখবো, রুখবো, প্রতিরোধ করবো, প্রয়োজনে প্রতিশোধ নেবো কলমে।

কালকের সব আনন্দের, আবেগের,ভালোবাসার মধ্যে মিশে ছিলো অসহায় মানুষের বেদনা, আছে দহন, কিছু করতে না পারার অসহায় দহন। দ্বিজেনের লাল চোখ, বেড়িতে বাঁধা হাত আমাকে নির্ঘুম রাখছে রাতের পর রাত। আমাকে ক্ষমা করো না ভূমিপুত্ররা।

লেখকের অন্য লেখা পড়ুন-
বন্ধু যদি অসাম্প্রদায়িক হও তবে প্রতিবাদ কর, প্রতিরোধ গড়

 

 

……………………………………………………………………………………………………………
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। womenwords.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে womenwords.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।