সংখ্যালঘু সম্প্রদা‌য় রক্ষায় ক‌ঠোর নিরাপত্তা আইন জরুরি - Women Words

সংখ্যালঘু সম্প্রদা‌য় রক্ষায় ক‌ঠোর নিরাপত্তা আইন জরুরি

রেজা ঘটক

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় সনাতন সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা প্রতি বছর নিম্নগামী হচ্ছে। ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষ, ১৯৪৬-৪৭ সালের হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা, ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগ, ১৯৬৪-৬৫ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ, ১৯৯১-৯১ সালে ভারতের বাবরি মসজিদকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত না হওয়ার কারণে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু মানুষের সংখ্যা বিশেষ করে সনাতন সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা ক্রমশ নিম্নগামী। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়ার পর নিরাপত্তাহীনতা এবং সনাতন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উপাসনালয়ের উপর বারবার আঘাতের কারণে সনাতন সম্প্রদায়ের দেশ ছেড়ে প্রতিবেশী ভারত বা অন্যদেশে যাবার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।

১৯০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সনাতন সম্প্রদায়ের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার শতকরা ৩৩.৯৩ ভাগ। ওই সময়ে এখানে মুসলিম সম্প্রদায়ের সংখ্যা ছিল শতকরা ৬৬.০৭ ভাগ। ১৯১১ সালে সনাতন সম্প্রদায়ের সংখ্যা দাঁড়ায় মোট জনসংখ্যার শতকরা ৩২.৮১ ভাগ আর মুসলিম সম্প্রদায়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৭.১৯ ভাগ। ১৯২১ সালে সনাতন ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সংখ্যা দাঁড়ায় যথাক্রমে শতকরা ৩১.৯০ ভাগ ও ৬৮.১০ ভাগ। ১৯৩১ সালে এই সংখ্যা দঁড়ায় যথাক্রমে শতকরা ৩০.৩৭ ভাগ ও ৬৯.৪৬ ভাগ। আর ১৯৪১ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় যথাক্রমে শতকরা ২৯.৬১ ভাগ ও ৭০.২৬ ভাগ।

এরপর চল্লিশের দশকের সেই জাতিগত বিপর্যয় কাল। নিরাপত্তাহীনতার কারণে সনাতন সম্প্রদায়ের মানুষ বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শুরু করলো। ১৯৫১ সালের আদমশুমারিতে তাই জনসংখ্যার আনুপাতিক চিত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন। ১৯৫১ সালে বাংলাদেশে সনাতন সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় মোট জনসংখ্যার শতকরা ২২.৮৯ ভাগ। আর তখন মুসলিম সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা দাঁড়ায় শতকরা ৭৬.৮৫ ভাগ। দেশ ভাগের পর পরিস্থিতি একটু শান্ত হলেও নিরাপত্তাহীনতার কারণে সনাতন সম্প্রদায়ের দেশ ছাড়ার সংখ্যা কিন্তু কমেনি। ১৯৬১ সালে জনসংখ্যার অনুপাত দাঁড়ায় যথাক্রমে শতকরা ১৯.২৮ ভাগ ও শতকরা ৮০.৪৩ ভাগ।

এরপর আবার ১৯৬৪-৬৫ সালের দাঙ্গার কারণে বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক সনাতন সম্প্রদায়ের মানুষ দেশ ছাড়ে। যে কারণে ১৯৭১ সালে জনসংখ্যার অনুপাত দাঁড়ায় যথাক্রমে শতকরা ১৪.৩০ ভাগ ও ৮৫.৪০ ভাগ। অর্থ্যাৎ চল্লিশের দশকে বাংলাদেশ থেকে প্রায় শতকরা ৭ ভাগ সনাতন সম্প্রদায়ের মানুষ দেশ ছেড়েছে। আর মুসলিম সম্প্রদায়ের সংখ্যাও প্রায় ৭ ভাগ বেড়েছে। আবার ষাটের দশকেও প্রায় শতকরা ৫ ভাগ সনাতন সম্প্রদায়ের মানুষ দেশ ছেড়েছে, যার বিপরীতে প্রায় ৫ ভাগ মুসলিম জনগোষ্ঠী বেড়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে মোট প্রায় এক কোটি দশ লাখ মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ৮০ লাখ (বা শতকরা ৭০ ভাগ) ছিল সনাতন সম্প্রদায়ের মানুষ। যুদ্ধের কারণে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে কোনো আদমশুমারি হয়নি। তাই ১৯৭৪ সালে একটি আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে দেখা যায় বাংলাদেশে সনাতন সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার শতকরা মাত্র ১৩.৫০ ভাগ অবশিষ্ট রয়েছে। ১৯৮১ সালের আদমশুমারিতে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় শতকরা ১৩.০৪ ভাগে। ওই সময় মুসলিম জনসংখ্যা ছিল শতকরা ৮৬.৬৫ ভাগ।

১৯৯১ সালে বাংলাদেশে সনাতন সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা দাঁড়ায় শতকরা মাত্র ১১.৩৭ ভাগে। তখন মুসলিম জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় শতকরা ৮৮.৩১ ভাগে। বাবরি মসজিদকে ঘিরে ১৯৯১-৯২ সালে আবার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা দিলে নব্বই দশকে বাংলাদেশের সনাতন সম্প্রদায়ের এই সংখ্যা আরো হ্রাস পায়। ২০০১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যায় এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৯.২০ ভাগে। আর ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা ও নির্যাতনের ফলে ২০১১ সালের আদমশুমারিতে এই সংখ্যা দাঁড়ায় শতকরা ৮.৫০ ভাগে। তখন মুসলিম জনসংখ্যা দাঁড়ায় শতকরা ৯০.০১ ভাগে।

বিগত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা, সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, নির্যাতন, সম্পত্তি দখল, ধর্মীয় উপাসনালয়ের উপর হামলা, আগুন দেওয়া, ভাঙচুর ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশে সনাতন সম্প্রদায়ের সংখ্যা আরো কমেছে। প্রতি বছর পূজার সময় বা বছরের অন্যান্য সময়ে সনাতন সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে আগুন, ধর্মীয় উপসনালয়ে হামলা, প্রতিমা ভাঙচুর, সম্পত্তি দখল, নির্যাতন, ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নানান কিসিমের নির্যাতনের ঘটনায় অনেকে নিরাপত্তাহীনতার কারণে দেশ ছেড়েছে।

গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগরে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের প্রতিবাদ করার নামে এক অজুহাতে উপজেলা সদরের অন্তত তিন শতাধিক সনাতন সম্প্রদায়ের বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। সেখানকার আটটি সনাতনপাড়ার অন্তত ১০ টি মন্দিরে হামলা করে প্রতিমা ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। এটি সাম্প্রতিক সময়ের সর্বশেষ ঘটনা। সনাতন সম্প্রদায়ের উপর এই হামলা মোটেও নতুন নয়।

বাংলাদেশে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের নামে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে নষ্ট রাজনীতির এক নতুন সংস্করণ। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের নামে আসলে সংখ্যালঘুদের দেশ ছাড়া করার সকল আয়োজন এখন বিদ্যমান। অথচ সারা দেশের প্রতিটি জেলায়-উপজেলায় সরকারি প্রশাসন রয়েছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়ে এমন হামলার ঘটনা ঘটেই চলেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে সনাতন সম্প্রদায়ের সংখ্যা কত? কাগজে কলমে পরিসংখ্যানে একটু বাড়িয়ে দেখালেও প্রকৃত সংখ্যা আসলে অনেক কমেছে। এই সংখ্যা কমে যাওয়ার ঘটনাটি সবার সামনে ঘটছে। নিরবেও ঘটছে।

তাহলে কী বাংলাদেশ ধীরে ধীরে হান্ড্রেড পারসেন্ট মুসলিম দেশ হবার দিকে ধাবিত হচ্ছে? বর্তমানে দেশে মুসলিম জনগোষ্ঠী কত? শতকরা ৯৩ ভাগের মোটেও কম হবে না। বাকি শতকরা ৭ ভাগ সংখ্যালঘুদের দেশ ছাড়া করার পেছনে প্রশাসন কেন তাহলে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালণ করছে? বিষয়টি কী সত্যি সত্যিই রাজনৈতিক? নাকি সম্পত্তি দখল, লুটপাট ও সংখ্যাগরিষ্ঠতার দৌরাত্ম?

বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক কোনো ঘটনার আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি। এই বিচারহীনতার কারণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিরাপত্তাহীনতায় এখানে বসবাস করছে। তাই বারবার হামলা, নির্যাতন, হুমকি, চোখ রাঙানোকে তারা ভয় পাচ্ছে। যার সহজ অর্থ দাঁড়ায়, যদি এখানে থাকো তাহলে এই নির্যাতন নিরবে সহ্য করতে হবে। আর যদি ভালোয় ভালোয় দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাও তো বাড়িঘর, জমি-সম্পত্তি যা আছে জলের দরে দিয়ে বিদায় হও!

অথচ আমাদের সরকারগুলো মুখে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা বললেও বাস্তবে সাম্প্রদায়িক নির্যাতের চিত্র কিন্তু তার উল্টো। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো, যারা এই ঘটনার নাটের গুরু তারা আবার রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে এসব করছে। কারণ ঘটনার পর এসব চিত্রের কোনো বিচার হয় না। এই বিচারহীনতা ওই সব আক্রমণকারীদের আরো উৎসাহিত করে পরবর্তী ঘটনা ঘটানোর জন্য। এ যেন এক চিরায়ত অসমাপ্ত নৃশংস গল্পের নিত্য চিত্রায়ন। আর তার একমাত্র বলি কেবল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এই নিবন্ধে আমি দেশের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী অর্থ্যাৎ সনাতন সম্প্রদায়ের পরিসংখ্যানগত চিত্র নিয়েই কেবল আলোচনা করেছি। অন্যান্য সম্প্রদায়ের চিত্র সেই তুলনায় যেমন অনেক কম, তেমনি তাদের অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল।

ইউরোপসহ পশ্চিমা বিশ্ব যেখানে মাল্টি কালচারকে সভ্যতার উৎকৃষ্ট মডেল ভাবছে, সেই একই সময়ে বাংলাদেশে নিরবে চলছে সংখ্যালঘুদের দেশ ছাড়া করার রাষ্ট্রীয় আয়োজন! তাহলে কী বাংলাদেশ মুখে অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলে বলে ভেতরে এক কঠিন সত্যকে লালন করছে? আর সেই সত্যর নাম হান্ড্রেড পারসেন্ট মুসলিম সম্প্রদায়ের দেশ? একটি দেশে মাল্টি কালচার না থাকলে সেই দেশের চিত্র কী হয়, তা কী আমরা বা আমাদের সরকার বা আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায় বা বাংলাদেশের টোটাল সমাজ একবারও অনুধাবন করতে পারছে? কোথায় যাচ্ছে আমার সোনার বাংলা? তাহলে কী আমরা দিনদিন ভিন্নমত, ভিন্ন জাতি, ভিন্ন সম্প্রদায় সহ্য করার সকল চরিত্র হারাচ্ছি?

সময় এসেছে বাংলাদেশ মাল্টি কালচার নিয়ে চলবে নাকি মাল্টি কালচার বিলুপ্ত করবে তার হিসাব নিকাশ করার। আমাদের নীতি নির্ধারকদের এ বিষয়ে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কেমন বাংলাদেশ চায় তারা। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়দের নিরাপত্তাহীনতা দূর করার জন্য এখন প্রচলিত আইনের বাইরেও কঠোর নিরাপত্তা আইন করা জরুরি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কেউ কোনো ধরনের হুমকি বা নির্যাতনের শিকার হলে, তারা যাতে সেই আইনের আশ্রয় নিয়ে বাপদাদার চৌদ্দ পুরুষের ভিটায় মাটি কামড়ে থাকতে পারে, সেরকম রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গঠন করার সময় এসেছে। নইলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে হটিয়ে যে হান্ড্রেড পারসেন্ট মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশ হওয়ার দিকে বাংলাদেশের যাত্রা, তা রুখে দেওয়া সম্ভব হবে না। মাল্টি কালচার না থাকলে ভবিষ্যতে এদেশ এক সাক্ষাৎ নরকে পরিনত হবে। আমাদের দেশের নীতি নির্ধারক, সরকার, প্রশাসন, শিক্ষিত সমাজসহ সর্বস্তরের মানুষকে মাল্টি কালচারের সেই বৈপরীত চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলার জন্য এখনই মাঠে সক্রিয় হতে হবে। নইলে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি হয়তো একসময় বাংলাদেশে ইতিহাসের পাতায় ঠাই নেবে। অতএব সাধু সাবধান!

 

 ……………………………………………………………………………………………………………
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। womenwords.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে womenwords.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।