ষাটোর্ধ্ব এক তরুণ নায়কের গল্প - Women Words

ষাটোর্ধ্ব এক তরুণ নায়কের গল্প

ছয়ষট্টি বছর বয়সেও তিনি যেন তরুণই। হালের জনপ্রিয় নায়কদের কাছেও তিনি প্রবল পরাক্রমশালী প্রতিদ্বন্দ্বি। যে বয়সের মানুষ বলতে আমাদের মানসপটে পিতামহর চেহারা ভেসে উঠতে চায় সেই বয়সে তিনি দূরন্ত দূর্বার। সদ্য তাঁর মুক্তিপাওয়া সিনেমা কাবালি রেকর্ড গড়ার পথে। তাকে নিয়ে ভারতের প্রভাবশালী আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পাদকীয় লিখেছে। পাঠকদের জন্য সেই লেখা তুলে ধরা হলো-
ছেষট্টি বছর বয়সেও তিনি বৃদ্ধ পিতামহ নহেন। আজও কেতার অপর নাম রজনীকান্ত। একদা তিনি আমাদের সানগ্লাস ঘুরাইতে ঘুরাইতে কী ভাবে খলনায়ককে পিটাইতে হয় শিখাইয়াছিলেন। সিগারেট উপরে ছুড়িয়া কী ভাবে পর মুহূর্তে তাহাকে ঠোঁটে লুফিয়া অগ্নিসংযোগ করিতে হয়, সেটিও তাঁহাকে দেখিয়া অনেকে অভ্যাসের চেষ্টা করিয়াছে, সফল হয় নাই। হইবার কথাও নহে। রজনী সামান্য মনুষ্য নহেন। ঈশ্বর ছয় দিনে পৃথিবী ও জীবজগৎ সৃষ্টি করিয়া, সপ্তম দিনে শুধুই বিশ্রাম ও রজনীকান্তকে সৃষ্টি করিয়াছিলেন। অতঃপর রজনী আদমকে এক বার ক্রুদ্ধ হইয়া নরকস্থ হও বলিয়া গালি গিয়াছিলেন, আদম পরদিন হইতে যমরাজ নামে খ্যাত হইলেন। রজনী আজও নিজেই আপন সেলফোনে মিস্ড কল দিতে পারেন, আইনস্টাইন তাঁহাকে দেখেন নাই বলিয়াই অঙ্কে ভুল করিয়া আলোকের গতিবেগ সর্বাধিক বলিয়া ধারণা করিয়াছিলেন।

ভক্তদের ভালবাসায় উৎসারিত রসিকতাগুলিই রজনীকান্তকে সৃষ্টি করিয়াছে। রজনী সেই নায়ক, যাঁহার ছবি মুক্তির আগেই ২০০ কোটি টাকার ব্যবসা করে। সারা রাত টিকিটঘরে লাইন দিয়া লোকে ভোর চারটেয় প্রথম শো দেখিতে দৌড়ায়, তামিলনাড়ুর অনেক সংস্থা তাঁহার ছবি মুক্তির দিনে ছুটি ঘোষণা করে। এমনকী মালয়েশীয় উড়ান সংস্থা সে দিন বিমানে কাবালির ছবি লাগাইয়া ভক্তদের চেন্নাই লইয়া যায়, সিনেমা দেখাইয়া ফেরত আনে। বাস্তব দুনিয়ায় পঞ্চান্ন বা সাতান্ন ইঞ্চি ছাতির অনেক সুপারম্যানকে লইয়া এই দেশ এত উদ্বেলিত হয় না। সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত কাবালি ছবিতে রজনী মুসলিম-অধ্যুষিত মালয়েশিয়ায় অনাবাসী ভারতীয় স্মাগলিং ডন। কিন্তু ইহাকে-উহাকে কাছে ডাকিয়া লন, ‘ফতিমা, তোমরা লেখাপড়া শেখো তো?’ রক্তমাংসের সুপারম্যানদের এই ঔদার্য থাকে না। তাঁহারা সাম্প্রতিক উত্তরপ্রদেশেও পাঁচ হাজার গ্রামে বিদ্যুদয়নের বাগাড়ম্বর করিয়া ক্ষান্ত দেন। মহম্মদ আখলাকের পরিবারকে সমবেদনা জানাইবার প্রয়োজন বোধ করেন না। বাস্তব সুপারম্যানদের লোকে ভয় পায়। রজনীকে ভালবাসে। ছুটিয়া-আসা বুলেটকে ছুরি দিয়া দুই টুকরায় চিরিয়া দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে বিদ্যুৎগতিতে ছুড়িয়া তাহাদের মৃত্যু ঘটাইলে সিনেমা হল করতালিতে ফাটিয়া পড়ে। জ্যাকি চানের পর তিনিই এশিয়ার সর্বাধিক বিক্রীত চিত্রতারকা, জাপানে তাঁহার জনপ্রিয়তার দরুন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকেও স্বীকার করিতে হইয়াছিল, রজনী দুই দেশের অন্যতম সেতু।

কিন্তু রজনী কোনও দিন এ সব লইয়া বাক্যব্যয় করেন নাই। তিনি জানেন, অতিরিক্ত আত্মপ্রচারে মানুষ আর সুপারম্যান থাকে না, পাদপ্রদীপে সহস্র সূর্যের আলোকপাত সত্ত্বেও জৌলুসে ভাটা পড়ে। এমন তো কতই ঘটিল। সুপারম্যান জানাইলেন, আমারই প্রেরণায় লোকে রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি ছাড়িয়াছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র লাভ করিতেছে, পরে অডিট-রিপোর্ট বলিল, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমার দরুণ লাভ হইয়াছে। খড়মাটির পাদদ্বয় প্রকাশিত হইল। রজনীর এমন হয় না। তাঁহার দীপ্তি অমলিন থাকে। তাহার আসল কারণ, তিনি নিজেকে নিজের প্রতিমার নিকট সঁপিয়া দেন নাই। সুপারম্যানের মুখোশ তাঁহার টাক মাথা, সাধারণ চেহারার মানবিক মুখটি ঢাকিতে পারে নাই। তাঁহার ছবির টাইটল কার্ডে ‘সুপারস্টার রজনী’ হিসাবে তাঁহার নাম আসে, বলিউডের শাহরুখ খানকেও চেন্নাই এক্সপ্রেসে উঠিয়া গাহিতে হয়, ‘অল দ্য রজনী ফ্যানস/ লুঙ্গি ডান্স।’ কিন্তু বাস্তব? মন্দিরে পূজা দিতে যান, কিন্তু আলোকচিত্রী সঙ্গে রাখেন না। একদা বেঙ্গালুরুতে বাস-কন্ডাক্টর হিসাবে জীবিকা নির্বাহ করিতেন, সেই তথ্যও অক্লেশে জানাইয়া দেন। অতীতটি স্পষ্ট, অন্য অনেক সুপারম্যানের ন্যায় ধোঁয়াশায় আবৃত নহে। তিনি সুপারমানুষ।

আইনস্টাইন থাকলে নিজের মত বদলে নিয়ে বলতেন, ঈশ্বর জুয়া খেলেন না বটে, কিন্তু শেয়ার বাজারের ফাটকায় তাঁর আপত্তি নেই। তিরুপতি ও সিদ্ধিবিনায়ক গজপতি মন্দির ব্যাঙ্কে ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলেছে, ভক্তরা ভগবানকে সরাসরি শেয়ার দেবেন। শেয়ার বাজারে লাভ হলে তো হবে ভগবানের আশীর্বাদেই, কাজেই তাঁকে তাঁর পাওনা দিয়ে দেওয়া। তবে, সরাসরি পাওনাগণ্ডার হিসেবে জড়িয়ে পড়ার পর ঈশ্বরের কাজকর্ম ইনসাইডার ট্রেডিং হয়ে যাবে না তো?