মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের জানা-অজানা গল্প (পর্ব-৩) - Women Words

মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের জানা-অজানা গল্প (পর্ব-৩)

reza-gotok-women-words‘ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা এই মাধবী রাত/আসেনি তো বুঝি আর জীবনে আমার/এই চাঁদের তিথিরে বরন করি/ওগো মায়াভরা চাঁদ আর ওগো মায়াবিনী রাত/বাতাসেরও সুরে শুনেছি বাঁশি তার/ফুলে ফুলে ওই ছড়ানো যে হাসি তার/সেই মধুর হাসিতে হৃদয় ভরি/এই চাঁদের তিথিরে বরন করি/ওগো মায়াভরা চাঁদ আর ওগো মায়াবিনী রাত/সব কথা গান সুরে সুরে যেন রূপকথা হয়ে যায়/ফুলঋতু আজ এল বুঝি মোর জীবনে ফুল ছায়/কোথায় সে কত দূরে জানি না ভেসে যাই/মনে মনে যেন স্বপ্নের দেশে যাই/আজ তাই কি জীবনে বাসর গড়ি/এই চাঁদের তিথিরে বরন করি/ওগো মায়াভরা চাঁদ আর ওগো মায়াবিনী রাত’। অগ্রদূত পরিচালিত ‘সবার উপরে’ ছবিতে গানটির গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার, সুরকার রবীন চ্যাটার্জি, আর কন্ঠ দিয়েছেন শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।

১৯৫৫ সালের ছবি ‘সবার উপরে’ সিনেমায় সুচিত্রা সেনের বিপরীতে অভিনয় করেন উত্তম কুমার। সুচিত্রা সেন অভিনয় করেন রীতা চরিত্রে। চাঁদনি রাতে দোতলা বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে সুচিত্রা যখন এই গানটি গায়, তখন প্রকৃতি যে কত মায়াময় হয়ে ওঠে, সেই নষ্টালজিয়ায় হয়তো এখনো আমরা অনেকে মাঝেমাঝে হারিয়ে যাই। উত্তম কুমার বিছানায় শুয়ে ছিলেন। জানালা খোলা। সেই পথে জোছনা দেখা যায়। গানও শোনা যায়। মায়াবী সেই গানে উত্তম কুমার বিছানা ছেড়ে একাকি পায়চারী করেন। একসময় বারান্দায় এসে একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন!

সুচিত্রা সেনের এমন একজন পাগল ভক্ত ছিলেন, যিনি নিজের বাড়িতে সুচিত্রা সেনের প্রমাণ সাইজের একটা ছবি দেয়ালে টানিয়ে রেখেছিলেন। এমন কি তিনি গোটা জীবন বিয়ে পর্যন্ত করেননি, ওই একটা ছবির সঙ্গে সারাজীবন কাটাবেন বলে! সেই ভক্তের কথা বলার আগে পাঠক চলুন শোনা যাক- করুণাময় দাশগুপ্ত ও ইন্দিরা দেবীর মেয়ে রমা দাশগুপ্ত কীভাবে সুচিত্রা সেন হলেন, সেই গল্প!

রূপালি পর্দায় রমা দাশগুপ্ত তখন বেশ কয়েকটি ছবি করেছেন কিন্তু কোনো ছবি তখনো তেমন বাজিমাত করেনি। ওই সময় কেউ কেউ সাজেস্ট করলেন নামটা বদলে নিলে ভালো হয়। কারণ, ‘রমা’ নামটা রূপালি পর্দার জন্য কেমন জানি কিছুটা হালকা হালকা! পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্ত প্রথম রমাকে অনুরোধ করেন নামটা বদলে ফেলতে। ওই সময় সুকুমার দাশগুপ্ত’র সহকারী ছিলেন নিতীশ রায়। এই নিতীশ রায়ের উপর দায়িত্ব পড়ে রমা দাশগুপ্তের জন্য নতুন একটা নাম খুঁজে বের করার।

তো অনেক ভেবেচিন্তে নিতীশ রায় রমা’র জন্য এমন একটি নাম বের করলেন, যে নামটি পরবর্তী কয়েক দশক বাঙালি সিনেমা দর্শকদের হৃদয়ে এমন একটি জায়গা করে নেবে, কেউ কী সেদিন তা একবারও ভেবেছিল? নিতীশ রায় রমা’র জন্য যে নামটি সেদিন রাখলেন সেই নামটিই আজকের বাঙালির অন্তরে জায়গা করে নেওয়া সুচিত্রা সেন। বিশেষ করে বাংলা সিনেমায় বাঙালি পুরুষদের হৃদয়ে এই নামটির মত এমন কাঁপুনি আর কেউ দিতে পেরেছে বলে আমার অন্তত জানা নেই!

‘ফরিয়াদ’ ছায়াছবির গান শোনাতে নচিকেতা ঘোষ গিয়েছেন সুচিত্রা সেনের বাড়ি। মন দিয়ে গান শুনলেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। গান শোনার পর সুচিত্রা সেন বললেন, শুনুন, গানের মাঝে হাসিটা কিন্তু আমি নিজে হাসব। আপনার আশা ভোঁসলে নয়। আমি রেকর্ড করে দেব। আপনি নিয়ে যাবেন। সুবোধ বালকের মত ঘাড় কাত করে তাতে সম্মতি জানালেন নচিকেতা ঘোষ।

কয়েক দিন পর নচিকেতা ঘোষ মুম্বই হাজির। এবার যথারীতি আশা ভোঁসলের বাড়িতে। ঘটনা সবকিছু শুনে আশাজি বললেন, ‘‘ইয়ে সুচিত্রা সেন নে হাসকে দিয়া, ইসসে আচ্ছা হাসি আউর হোগাই নেহি। শুনাইয়ে সুচিত্রা সেন কা রেকর্ড। দেখুঙ্গি ক্যয়া হ্যায় উসকি হাসি মে, জো মেরা নেহি হ্যায়!’’ শিল্পীদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে এভাবে কাজ আদায় করে নিতেন নচিকেতা ঘোষ।

‘ফরিয়াদ’ ছবিতে সেই গানটি ছিল ‘নাচ আছে গান আছে, রূপের তুফান আছে/যা কিছু কিনতে চাও কেনো না/ চোখের-ই জল শুধু তুমি চেয়ো না/একে যায় না কেনা, এ তো কেউ পাবে না, এ আমার-ই থাক/অনেক নেশা ঝলক আছে/হরিণ চোখের পলক আছে/এ চোখ কিনতে চাও কেনো না/ চোখের-ই জল শুধু তুমি চেয়ো না/আরো আরো যত পারো/ছুড়ে দাও ছুড়ে দাও সোনা চাঁদের ঝুটি/মারো না আমায় মারো না/আমি হাসি, শুধু হাসি, আমার লাগে না ব্যথা, লাগে না লাগে না, লাগে না হা হা হা/এ চোখ কিনতে চাও কেনো না/আরো আরো যত পারো, কেড়ে নাও কেড়ে নাও আমার সাধের স্বপ্ন/যে টুকু লজ্বা আছে কোরো না/আমি হাসি, শুধু হাসি, আমার লাগে না ব্যথা, লাগে না লাগে না, লাগে না, হা হা হা/যা কিছু কিনতে চাও কেনো না/শুধু চোখের জল ওগো তুমি চেয়ো না’।

এরপর রেকর্ডিং-এর সময় গাইতে গাইতে আশা ভোঁসলে এক পর্যায়ে হাসতে হাসতে কেঁদে ফেললেন! ‘আমি হাসি শুধু হাসি…আমার লাগে না ব্যথা লাগে না…। তারপর? কলকাতায় ফিরতে রেকর্ডিং শুনলেন সুচিত্রা সেন। নচিকেতা ঘোষের সামনে সুচিত্রা সেন তখন একেবারে স্তব্ধ। পুরোপুরি মুগ্ধ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর সুচিত্রা সেন বললেন, ‘‘এ যাত্রায় আমার হাসিটা বাদ থাক! পাঠক ভাবুন একবার। একজন শিল্পী কতোটা নিজের সর্বস্ব উজার করে ঢেলে দিলে আরেকজন শিল্পী তাতে এমন সম্মান দেখাতে পারে!

‘আজ দুজনে মন্দ হলে মন্দ কি/দেখো ময়ূরপঙ্খী রাত যে আলোয় ঝিলমিলে/আহা এমন রাতে এসো না আজ ভাব করি/আহা এই ফাগুনের বাহার তো কাল থাকবে না/ও ভ্রমর, তখন তুমি ফুলের খবর রাখবে না/যৌবনেরই রঙ মশাল, জ্বলছে দেখো রঙ মাতাল/সেই আগুনে আজকে না হয় ঝাঁপ দিলে/দেখো ময়ূরপঙ্খী রাত যে আলোয় ঝিলমিলে/আহা এমন রাতে এসো না আজ ভাব করি/যদি তোমার চোখে আমার চোখে রঙ লাগে/আর, একটু ছোয়ায় রক্তে যদি ঢেউ জাগে/দোহাই বলো দোষটা কি/মনকে কেনো দাও ফাঁকি/ও, মৌমছি! একটু না হয় আজকে তুমি মৌ নিলে/দেখো ময়ূরপঙ্খী রাত যে আলোয় ঝিলমিলে/আহা এমন রাতে এসো না আজ ভাব করি’।

এটাও ‘ফরিয়াদ’ ছবির গান। গানটির গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার আর সুরকার নচিকেতা ঘোষ। আর গানটি গেয়েছেন শিল্পী আশা ভোঁসলে। ফরিয়াদ ছবির পরিচালক ছিলেন বিজয় বসু। আর এ ছবিতে সুচিত্রা সেনের বিপরীত চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন উৎপল দত্ত। সুচিত্রা সেন করেছিলেন রতনমালা চরিত্রটি। আর ‘ফরিয়াদ’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭১ সালে।

একবার বিজলী সিনেমার ম্যানেজার বিশ্বাবসু রায় চৌধুরীর ঘরে দেখা গেল রমা দাশগুপ্তকে। সঙ্গে তাঁর স্বামী দিবানাথ সেন। মিসেস সেনের চেহারায় সাজগোছের কোনো চিহ্ন নেই! তখন উপস্থিত কেউ কেউ বললেন, সলজ্ব দেখা যে কোনো গৃহবধূর তুলনায় রমা ছিলেন সত্যি সত্যি একেবারে আলাদা। ছাই চাপা আগুনের মত চেহারা ছিল সেদিন রমা সেনের। আর মনের কোনে কীসের যেন এক হতাশা! তাই রমা ম্যানেজার বিশ্বাবসুকে বলেছিলেন, আর ট্রায়াল দিতে পারছি না। আর স্ক্রিন টেস্ট দিতে পারছি না!

বিশ্বাবসু রায় চৌধুরী একটা ছবি ম্যানেজ করে দেবেন এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ছবি তো রাতারাতি হয় না। ওদিকে রমা যে সেদিন ওভাবে ছাই চাপা আগুন থেকে একেবারে দাবানল হয়ে উঠবেন, কেউ ভাবতেও পারেননি। যে ‘সাত নম্বর কয়েদী’ ছবিতে সুচিত্রা সেন তেমন আলোড়ন তুলতে পারেননি, যে সকল সংবাদপত্র তাঁকে নিয়ে সেদিন লিখেছিলেন যে নবাগত সুচিত্রা সেন রূপালি পর্দায় উত্তীর্ণ হবার নম্বরটুকু হয়তো পেতে পারেন, কিন্তু তা আহামরি তেমন কিছু না। সেদিন বিজলী সিনেমার ম্যানেজার বাবুর রুমে অমন দাবানল আর কেউ কোনো দিন দেখেননি।

তারপর নিজের প্রত্যয় আর সাধনায় সেই সুচিত্রা সেন কোটি কোটি বাঙালির হৃদয় জয় করলেন কেবল অভিনয় দিয়েই। একবার ভাবুন তো, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে কতটা প্রত্যয় আর দৃঢ়তা লাগে একজন শিল্পীর জীবনে। যেটাতে ভেসে যায় জীবনের ফেলে আসা সকল ব্যর্থতা আর গ্লানিটুকু! সেই দৃঢ় প্রত্যয়ের ভেতরে কমিটমেন্ট আর সাধনা ছিল বলেই আমরা একজন সুচিত্রা সেন পেয়েছি। বাঙালি সিনেমা দর্শকরা পেয়েছে এক অমর শিল্পীকে । আর তিনি বাংলা সিনেমায় এককভাবে রাজত্ব করা সুচিত্রা সেন।

চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা