বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ: নেপথ্যে নানা কারণ দেখছেন মনোবিজ্ঞানীরা - Women Words

বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ: নেপথ্যে নানা কারণ দেখছেন মনোবিজ্ঞানীরা

ঢাকার দু’টি সিটি কর্পোরেশন এলাকায় প্রতিবছর ৫ হাজার ১৪৩টি বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। দুই কর্পোরেশনের তালাক রেজিস্ট্রি দপ্তর জানাচ্ছে – দিন দিন ভয়াবহ আকারে বেড়েই চলেছে বিবাহবিচ্ছেদ। ঢাকায় এর প্রবণতা ইতিমধ্যেই ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। এরমধ্যে নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে প্রভাবশালী ও তারকা পরিবারও রয়েছে। বিচ্ছেদের দুই-তৃতীয়াংশ নোটিশই আসছে নারীর কাছ থেকে। আর ঢাকা শহরের তুলনায় সারাদেশে এই চিত্র আরও ভয়াবহ।

বিবাহবিচ্ছেদের নেপথ্যে নানা কারণ দেখছেন মনোবিজ্ঞানীরা।

‘‘পারিবারিক, সামাজিক বন্ধন দুর্বল হচ্ছে ক্রমশ। যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে মানুষ। ভালোলাগা-ভালোবাসাও যাচ্ছে কমে। ফলে বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ,’’ বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তানিয়া হক।

দেখছেন মনোবিজ্ঞানীদের মতে, নির্যাতন, মাদকাসক্ত, সন্দেহ প্রবণতা, একে-অপরের অবাধ্য হওয়া, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে না চলা, পুরুষ নির্ভরশীলতা কমে যাওয়া, আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি, স্বাধীনচেতা ও শূন্যতা বিরাজ করা, তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার, পরকীয়া ও সামাজিক অবক্ষয়ের ফলে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটছে। এছাড়া রয়েছে আধুনিকতার বিষয়ও। তবে স্বাধীনচেতা নারীর জন্য বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখার অবকাশ রয়েছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. জিল্লুর রহমান খান রতন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমাদের বন্ধনটা দুর্বল হচ্ছে। পাশাপাশি নারীরা সাবলম্বী হচ্ছেন। অনেক নারী আগে অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেও স্বামীর সংসারে থাকতেন। কিন্তু এখন তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোও এখানে ভূমিকা রাখছে। স্বামী স্ত্রীকে সময় না দেয়ার কারণে স্ত্রী সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। সেখানে কারো সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে। এক পর্যায়ে পরকীয়ার সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছেন তাঁরা। শেষ পর্যন্ত তালাক পর্যন্ত গড়াচ্ছে বিয়ে। এখানে একজনের অন্যজনকে বোঝার বিষয় আছে, সময় দেয়ার ব্যাপার আছে, সম্মান দেয়ার বিষয় আছে। এগুলো অবহেলা করলে শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদে রূপ নিচ্ছে। ’

ঢাকা শহরের দুই সিটি কর্পোরেশনের ১০ অঞ্চলের হিসাব মতে, ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সময়ে রাজধানীতে ৩৬ হাজার ৩৭১টি বিবাহবিচ্ছেদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নোটিশ কার্যকর হয়েছে ৩০ হাজার ৮৫৫টি। দেখা যাচ্ছে, এ সময়ে স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামীকে তালাকের নোটিশ দেওয়া হয়েছে ২৪ হাজার ৮০৩টি এবং স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে তালাকের নোটিশ দেওয়া হয়েছে ১২ হাজার ১৮টি। এই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ১৫টি, মাসে ৪২৯টি এবং বছরে ৫ হাজার ১৪৩টি সংসার বিচ্ছেদ ঘটছে।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে জমা পড়া তালাকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মূলত উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারে বিচ্ছেদ বেশি হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, গত ৬ বছরে দুই সিটি এলাকায় বিচ্ছেদ কার্যকর হয়েছে ৩০ হাজার ৮৫৫টি, যাঁদের অধিকাংশের বয়স ৩০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে এবং যাঁরা উচ্চ ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য। এছাড়া বিয়ের এক বছর না যেতেই তাঁরা বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের কেউ কারো কথা শুনতে চান না। তাঁরা যে যাঁর কথা মতো চলেন। উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যরা মনে করেন, অঢেল অর্থ সম্পদ রয়েছে, তাই বিচ্ছেদ হলে সমস্যা হবে না। আর নিম্নবিত্ত পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ফারাক থাকে বেশি। বেশিরভাগ পরিবারের নারীরা চাহিদা অনুযায়ী অনেক কিছুই পান না, অভাব অনটন সব সময় লেগেই থাকে। ফলে ঝগড়া, বিবাদ সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা লোকলজ্জার ভয়ে সাধারণ ঘর ভাঙতে রাজি হন না। ’

উইম্যান অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, ‘আমরা যেভাবে বড় হয়েছি, এখনকার বাচ্চারা সেভাবে বড় হচ্ছে না। তাদের চাহিদা অনেক বেশি। তাদের উপর চাপও বেশি। তারা খেলার মাঠে যায় না। আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা হয় না, ফলে তারা জানে না বন্ধনটা কী জিনিস। এই বাচ্চারা একা একা বড় হচ্ছে। তাই বিয়ের পর স্ত্রীর সঙ্গেও সম্পর্কটা স্বাভাবিক হচ্ছে না। ’

তবে তাঁর কথায়, ‘মূলত নারীর স্বাধীনতা, সচেতনতা এবং উপার্জন ক্ষমতা বাড়ায় তাঁরা খুব সহজেই বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। আসলে আমাদের সংসার টিকাতে হলে স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সম্মান করতে হবে। ভালোবাসা থাকতে হবে। একজনের অন্যজনকে বুঝতে হবে। এভাবে চললে তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ’

সূত্র: ডিডাব্লিউ