বাংলাদেশে গৃহকর্মী নির্যাতনের বিচার কেন হয় না - Women Words

বাংলাদেশে গৃহকর্মী নির্যাতনের বিচার কেন হয় না

আবুল কালাম আজাদ

অভাবের তাড়নায় গৃহকর্মী হিসেবে ঢাকাসহ শহরের বাড়িতে কাজ করে বেশিরভাগ মেয়েরা।  বাংলাদেশে গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসেব অনুযায়ী, গত দশ বছরে ১ হাজার ৭০টি গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৫৬৫ জনের।

সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে চাষাঢ়ায় বেইলি টাওয়ারের ৫ম তলায় আয়েশা বেগমের বাসায় রাজিয়া নামের এক গৃহকর্মীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় গত ২০ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করেছেন রজিয়ার দাদী। মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, বিষপানে রাজিয়ার আত্মহত্যার কথা। তবে এ মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে বামপন্থী দল বাসদ ও সিপিবি। প্রবাভশালী ব্যক্তির বাড়ীতে গৃহকর্মী রাজিয়ার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে তারা মনে করছে।

বাসদের নারায়ণগঞ্জ জেলা সমন্বয়ক নিখিল দাস বলেন, “রাজিযাকে গ্রামের বাড়ী না পাঠিয়ে তাকে পাঠানটুলী কবরস্থানে দাফন করা হলো, যে বাবার পরিচয় দেয়া হলো সে সত্যিকারের বাবা না। এবং তার গ্রামের যে ঠিকানা দেয়া হলো সেটা ভুল এবং মিথ্যা।”

এ ব্যাপারে পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা আজগর আলী বলেন, ঘটনা তদন্তের জন্য তারা লাসের ময়না তদন্তের রিপোর্টের অপেক্ষায় আছেন। যদি তদন্তে হত্যার আলামত আসে সেক্ষেত্রে বাদীপক্ষ মামলা না করলে সরকার বাদী হয়ে হত্যা মামলা করবে।”

ঢাকার মোহাম্মদপুরে চলতি বছরের মে মাসে নির্মম নির্যাতনে মারা যায় গৃহকর্মী হাসিনা। কাজে দেয়ার চারমাসের মাথায় তার মৃত্যু হয়। ১১ বছর বয়সী হাসিনার সমস্ত শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন ছিল। ময়না তদন্তে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল বলেও আলামত পাওয়া যায়।

হাসিনার বাবা রিকশা চালক আব্দুস সোবাহান । মেয়ে মারা যাওয়ার পর ঢাকা ছেড়ে এখন গ্রামে চলে গেছেন স্বপরিবারে। সোবহান বলছিলেন, “আমার বাড়ী নাই, ঘর নাই কিছু নাই। বাচ্চাডারে লয়া দুই জামাই বউ গেছিলাম ঢাহায়। ভাবছিলাম সুন্দরভাবে চলবো। হেয় বাচ্চাডারে কিভাবে মারলো হে কি মানুষ না পশু?”

গৃহকর্মী হাসিনা হত্যা মামলার আসামীরা গ্রেপ্তার হয়েছে। শিগগিরই এ মামলায় অভিযোগপত্র দেয়া হবে বলেও জানাচ্ছে মোহাম্মদপুর থানার পুলিশ।

জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, “আমরা একটা কেসও কিন্তু এখন পর্যন্ত জাজমেন্ট সেরকম দেখি নাই যে গৃহশ্রমিককে মারার কারণে শাস্তি হয়েছে। যে দিনের ভেতরে ইনভেস্টিগেশন শেষ হওয়া এবং একটা কেস শেষ হওয়ার কথা সেরকম হচ্ছেনা। এ ধরনের সেনসিটিভ কেসগুলা যদি ফার্স্ট ট্রাক কোর্টে শেষ করে ফেলা যায় ৬-১৮০ দিনের মধ্যে, তাহলে কিন্তু অনেকগুলা ভাল শাস্তি আমরা দিতে পারি, সেগুলো কিন্তু হয় না।”

তিনি বলেন, “গৃহকর্মীরা সবাই হতদরিদ্র কিন্তু দোষীরা সবাই প্রভাবশালী। এখানে তদন্ত সময়মতো হয় না, করাপশন থেকে শুরু করে অনেক বিষয় আছে। আর কেস যখন চলতে থাকে একটা পর্যায়ে গিয়ে বাবা-মায়েরা আপস করে ফেলে, টাকা-পয়সা নিয়ে মিটমাট করে ফেলে।”

বেসরকারি সংস্থার হিসেবে বাংলাদেশে বছরে গড়ে ৫০ জনের বেশি গৃহকর্মী নির্যাতনের কারণে মৃত্যুবরণ করছে। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের হার উদ্বেগজনক এবং গৃহকর্মী নির্যাতনের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়না বলেই এ ঘটনা কমছে না।

বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র নির্যাতনের অনেক মামলায় আইনি সহায়তা দেয়। তাদের হিসেবে গত দশ বছরে গৃহ পরিচারিকা নির্যাতনে ঘটনায় ৫শ মামলা হয়েছে।

সংস্থার সিনিয়র উপপরিচালক নীনা গোস্বামী বলেন, “এই চিত্রটা এত ভয়াবহ যে একটা মামলারও যদি আমরা রেজাল্ট না আনতে পারি, তাহলেতো মানুষ ভাববেই যে আমরা যে ধরনের অপরাধ করছি এটা আমরা পার পেয়ে যাব, আমাদের বিত্ত দিয়ে ঢেকে ফেলবো, এটাই ঘটছে এবং দিনে দিনে এই ভয়ানক নির্যাতনটা বেড়ে যাচ্ছে।”

যে সমস্ত ঘটনা সরাসরি বা পত্রপত্রিকায় বরাত দিয়ে জানা যায়, বাস্তবে গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা আরো অনেক বেশি বলেই মনে করেন নীনা গোস্বামী। তিনি বলেন, “এখানে আইনজীবী, খেলোয়াড়, শিল্পী, ডাক্তার, সাংবাদিক, ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ কোনো প্রফেশনের মানুষের বাসাতে বাদ নেই যে গৃহপরিচারিকা নির্যাতন হয়নি। এটা ধরেই নেয়া হয় যে তারা বাসার দাস”

সৌজন্যে: বিবিসি বাংলা