বন্ধ হোক মেয়েদের অসম্মান করা প্রথা সব - Women Words

বন্ধ হোক মেয়েদের অসম্মান করা প্রথা সব

রাহিমা বেগম

নিজের একজন নিকট আত্মীয়ের গল্প দিয়ে শুরু করছি। উনাদের পিতা মারা গেছেন অনেক আগেই। মা অনেক কষ্টে ছেলে মেয়েদের পড়ালেখা করানোর চেষ্টা করেছেন। আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই বেশ অবস্থাসম্পন্ন।তাই সব সময় সকলে সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন প্রতিনিয়ত। তাদের বিয়েতেও সবাই সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন।

সিলেটের বিয়ে মানে তো বোঝেন! কাড়ি কাড়ি যৌতুক, আজীবন যৌতুক, সে যে বা যত ভদ্র সদ্দর পরিবার ই হোক। ফ্রিজ, টিভি, ওয়াশিং মেশিন থেকে শুরু করে ঝাড়ৃ, দা, সিল-পাটা সবই দিতে হয়। যদিও আমাদের সিলেটিরা এটাকে যৌতুক বলার পক্ষে না। কিন্তু কেন এগুলো যৌতুক নয় তা আমার বোধগম্য নয়। আর আজীবন যৌতুকের মধ্যে পরে আম কাঁঠলি, মানে গ্রীষ্মকালীন ফল ঠেলা বা ট্রাক ভর্তি করে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে পাঠানো, রমজান মাসে প্রথম দিনের ইফতারী, পরে বড় করে শ’খানেক মানুষের উদরপূর্তি করার জন্য ইফতারের ডালি। এই প্রথা চলতে থাকে মেয়েটির নাতি নাতনি হওয়ার পর পর্যন্তও।

যাই হোক মূল গল্প থেকে সরে গেছি। তাদের বিয়ের যৌতুকগুলো ও আত্মীয়সজন ব্যবস্থা করে দিলেন। এদের এক বোনের বিয়ের পর প্রথম রমজানের মাসে ইফতারির টাকা সংগ্রহ করার জন্য মা অবস্থাসম্পন্ন আত্মীয়দের কাছে মাথা নীচু করে সাহায্য চাইতে গেলেন। বললেন, যদি সম্ভব হয় তবে যাকাতের টাকা থেকে হলেও ইফতারির টাকা সংগ্রহ করে দিতে। তখন ঐ আত্মীয়দের একজন উত্তর দিলেন , ‘এত যদি মেয়ের বাড়িতে ইফতারী দেয়ার সখ তাহলে ভিক্ষা করে টাকা সংগ্রহ করে দিলেই তো পারেন।’

সেদিন আমি ছিলাম সামনে। সম্ভ্রান্ত পরিবারে মা প্রয়োজনে না খেয়ে থাকতে পারবেন, তবু পারিবারিক সম্মান রক্ষার জন্য ভিক্ষা করতে পারবেননা। কথাটা শুনেই সেই মা আরো চুপসে গেলেন, দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। আমার রাগে মাথা গরম হয়ে উঠলো, দুচোখ দিয়ে আগুন বের হলো। না, আমার রাগ উনার উপর হলোনা, যিনি একজন অসহায় মাকে অসম্মান করলেন। আমার রাগ হলো আমাদের পূরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার উপর- যে সমাজ এই মাকে অসহায় করেছে, যে মাকে এত কষ্ট করে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার পর ও প্রতিবছর আম কাঁঠলি ইফতার নামক যৌতুক সংগ্রহের জন্য আমৃত্যু এই কষ্ট সহ্য করে যাওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছে, সেই সমাজের উপর।

গল্পটি বছর নয়/দশ আগের। সেদিন আমি উপলব্ধি করেছিলাম আমাদের সিলেটের ধনি পরিবারগুলো মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে সামান্য লোক দেখানো স্টেটাস বাড়াতে গিয়ে সিলেটে ইফতার আর আম কাঁঠলি নামক যে যৌতুক প্রথা চালু রেখেছেন, তা দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবার গুলোর কতটা কান্নার কারণ। মূলত আমি সেদিন থেকে এইসব প্রথার ঘোর বিরোধী। একসময় নিরবে এসব অনুষ্ঠান এভয়েড করতাম। আমার বোনদের বিয়ের পর আম্মার সাথে প্রতিনিয়ত বারগেইনিং করতে করতে চার পাঁচ বছরে বন্ধ করতে পেরেছি।আম কাঁঠলি বন্ধ হলেও আম্মা গোপনে বোনদের হাতে ইফতার নামক যৌতুকের টাকা তুলে দেন।

যাই হোক সিলেট থেকে এই তিনটা যৌতুক নির্মুল করতে আমি কাজ করে যাব, কেউ আগ্রহী থাকলে আমার সাথে কাজ করতে পারবেন।

আমাদের সিলেটের মেয়েগুলো বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত মেয়েগুলো একটু বেশী পরিমাণে নির্বোধ। বিয়েতে ফার্ণিচার সহ সব যৌতুক, আম কাঁঠলি, ইফতার কেন আমাদের সিলেটের সংস্কৃতিতে আসছে, এগুলো থাকার কুফল কি এগুলো তারা কখনো বিবেচনায় আনতে পারেননা।

সিলেটের সংস্কৃতি বাংলাদেশের ৬০ টি জেলা থেকে সম্পুর্ণ ভিন্ন। এই এলাকার লোকজন অনেক রিজার্ভ। মেয়েদের শিক্ষার হার বরাবর খুব কম ছিল, সংসার কর্ম ছাড়া অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে মেয়েদের সুযোগ খুবই সীমিত। একসময় সিলেটের মেয়েরা লেখাপড়ায় অনেক বেশী পিছিয়ে ছিল, এমনকি লেখা পড়া করলে আয়বৃদ্ধিমূলক কাজে মেয়েরা ছিলনা বললেই চলে। ফরায়েজী সম্পত্তি যেটা সিলেটে ফরাইজ নামে পরিচিত। ফরাইজ শব্দটা নেতিবাচক অর্থে সিলেটে ব্যবহার হয়, মেয়েরা কেউ ফরাইজি সম্পত্তি দাবী করলে এখনো আমাদের সিলেটে খুব নীচু মনের মেয়ে ভাবা হয়, সংসারে অশান্তি শুরু হয়ে যায়, ঐ মেয়ের সাথে সবার পারিবারিক বন্ধন শীথিল হয়ে যায়। সম্ভবত মেয়েরা বিয়ের পর যাতে ফরাইজ না চাইতে আসে তাই সকলে মিলে কষ্ট করে এইসব হাবিজাবি ফার্ণিচার, সিল পাটা বিয়েতে দেওয়ার প্রথা চালু করেন। যেহেতু মেয়েরা চাকুরী বা ব্যবসা বাণিজ্য কিছু করত না আবার বাবার সম্পত্তির ও কিছুই পেতনা তাই শশুর বাড়িতে যতই নির্যাতন করা হোক, অবহেলা করা হোক তাদের কোথাও যাওয়ার কোন জায়গা ছিলনা, বা যাওয়ার মত কোন অবস্থা ছিলনা। বাবার বাড়িতে ফিরে আসারও সুযোগ নাই কারণ সেখানে ফেরত এসে তার নিজস্ব কোন সম্পত্তিতে তার কোন অধিকার নাই, যেটাকে আশ্রয় করে তার জীবনের বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দিতে পারবে। অনেকে ডিভোর্স বা বাধ্য হয়ে বাপের বাড়িতে ফিরে এলে ও সবসময় অন্যের করুণা, সাহায্য এসব নিয়ে মাথা নীচু করে জীবণটা পার করে দিতে হয়। যেহেতু সিলেটের মেয়েরা এতটা অসহায় ছিল সবসময় তাই ইফতার, বৈশাখী আম কাঁঠলি, শীতের পিঠা, শবেবরাতের সময় চাঁদের সিন্নী এই সব বিভিন্ন প্রথা চালু করে মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকজনকে সম্ভবত তুষ্ট করার প্রয়াস চলত। বিষয়টা ছিল এমন-মেয়েটা তোমাদের পরিবারে যেমন ই থাকুক তবু মেয়েটিকে কোনদিন ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে আমাদের বোঝা বাড়িয়ে দিওনা। বিনিময়ে তোমাদের চৌদ্দ গোষ্ঠিকে বছরের বিভিন্ন সময় উদরপূর্তি করে খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিব।

এবার বলি কেন বর্তমান সিলেটের উচ্চশিক্ষিত মেয়েদের নির্বোধ বললাম কারণ এখন সিলেটে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের শিক্ষায় সফলতা বেশি। মেয়েরা লেখাপড়া শেষ করে বসে নেই। চাকরি করছে, অনেকে বিভিন্ন ধরণের ক্ষুদ্র ও বৃহৎ ব্যবসাও করছে। আচ্ছা মেয়েরা তোমরা তো তোমাদের চেয়ে খুব যে বেশি যোগ্যতা সম্পন্ন ছেলেদের বিয়ে করছো তা তো নয়। তোমরা তো অন্ধ কানা, খোঁড়াও নও বা যেকোন উপরিস্থিতে তোমরা পরিবার বা সমাজের বোঝা হবেনা। নিজেকে, নিজের সন্তানদের নিয়ে চলার মত সামর্থ তোমরা রাখ। তাহলে কেন তোমরা তোমাদের সম্মানে আঘাত করা হয় এমন প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারনা, কেন তোমরা এগুলো তোমার নিজের ক্ষেত্রে বন্ধ করছনা, কেন বুঝছনা মেয়েদের অসহায় ও দুর্বল ভেবে যেসব প্রথা চালু আছে সেগুলো বন্ধ না করলে তোমরা যত উচ্চ পদেই চাকরি করনা কেন তোমাদের সঠিক মূল্যায়ন কখনো হবেনা, তোমরা তোমাদের সম্মান ও সঠিক মর্যাদা পাবেনা।

আর ছেলেদের জন্য করূণা হয় কারণ তারা সম্পত্তির লোভ ছেড়ে বোনদের এখনো বলতে পারেনা বোনেরা তোকে কখনো কোথাও মাথা নীচু করে অসম্মানে বাঁচতে হবেনা, ধর্মীয় বিধান অনুসারে প্রাপ্য তোর সকল সম্পত্তির ভাগ তোকে দিব, বউ তোমার অবস্থান আমার পরিবারে আমার অন্য সব সদস্যদের মতই, তুমি যেমন আমার পরিবারের সকল দায়িত্ব পালন করবে, সবার সম্মান রক্ষা করবে আমরা তোমাকে সেই একই সম্মান. একই মর্যাদা দিব। আমাদের পরিবারে তোমার মর্যাদা বাড়ানোর জন্য তোমার পরিবার থেকে কোন যৌতুক নিয়ে আসতে হবেনা। তোমাকে যেমন আমি ভালোবাসি , তোমার সম্মান, মর্যাদাকেও সমান ভালোবাসি, ভালোবাসি তোমার বাবা মাকেও। তাই আলাদাভাবে তোমার সম্মান বাড়ানোর জন্য তোমার বাবা মাকে এই কষ্টগুলো করতে হবেনা।

শুধু লেখাপড়া করে ভাল চাকরী আর ব্যবসা করে সমাজে সম্মান প্রতিষ্ঠিত হয়না, সেজন্য আত্মসম্মান থাকাটা আবশ্যক। সেদিকে সবার নজর দেয়া উচিত।