বন্ধুসঙ্গ - Women Words

বন্ধুসঙ্গ

আব্দুল করিম কিম

এই মধ্যবয়স অবধি অগণিত মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে, মেলামেশা হয়েছে কিন্তু সবার সাথেতো বন্ধুত্ব হয়নি । কারো সাথে প্রথম পরিচয়েই বন্ধুত্বের সূচনা হয়েছে, কারো সাথে চলতে চলতেই হয়েছে বন্ধুতা। এক বেঞ্চে স্কুল-কলেজে পড়েছি এমন কেউ কেউ শুধু সহপাঠী থেকেছে বন্ধু হতে পারেনি বা হতে চায়নি । আবার কেউ কেউ শিক্ষাঙ্গনে উপরের ক্লাস বা নিচের ক্লাসের হয়েও শৈশবের খেলার সঙ্গী হিসাবে প্রানের বন্ধু হয়ে আছে । আমি যাকে বন্ধু ভাবি সেও যে আমাকে বন্ধু ভাবে এমন নাও হতে পারে । আমার তাতে কিছুই যায় আসে না । আমি যাকে বন্ধু ভাবি, আমার তাঁর সঙ্গে কথা ফুঁড়ায় না । সে আমায় ছুটির নিমন্ত্রনে ডাক পাঠালে আমি ফেরাতে পারি না ।

সময় ও বাস্তবতা সব বন্ধুর কাছে চাইলেই নিয়ে যেতে পারে না কিন্তু ‘বন্ধুসঙ্গ’ আজীবন আনন্দের । জীবনের নানান পর্বে বন্ধুর তালিকা বেশুমার । এই বন্ধুদের অনেকেই এখন সামাজিক যোগাযোগের সঙ্গী শুধুমাত্র ‘ফেইসবুক’ বন্ধু হয়ে আছে । পোষ্ট বা ছবিতে লাইক দেয়া ছাড়া আজকাল অনেকের সাথে তেমন কোন কথা হয় না । দেখা হলেও কেউ কাউকে কোন প্রশ্ন করা হয় না । সবাই সব কিছু জানি । কে এখন কি করে ? কার কবে ছেলে বা মেয়ে হল, কার কবে মন ভালো বা মন্দ, কে অফিস করে করে ক্লান্ত, কে কবে বউকে নিয়ে কাঠমুণ্ডু ঘুরে এলো, কে গতকাল দুর্ঘটনা থেকে মরতে মরতে বেঁচেছে, সব এখন জানা । আগে জিজ্ঞেস করা হত- এই নিখিলেশের সাথে কি তোর যোগাযোগ আছে ? এখন জিজ্ঞেস করা হয় না । কারন ‘নিখিলেশ’ আমাদের ‘মিউচুয়াল ফ্রেন্ড’ । ‘সুজাতা’ যে অনেক ভালো আছে এটা প্রায় প্রতিদিন তাঁর নতুন নতুন প্রোফাইল পিকচার দেখে জানা হয়ে যায় । ‘মইদুল’ কি লেখে না লেখে- এটা এখন তাঁর আর পড়ে শোনানো লাগে না । প্রায় প্রতিদিন তাঁর লেখাগুলো শেয়ার হয়ে আমার দেয়ালে আসে । ‘বেলা বোস’ যে কতটা বদলে গেছে- এই পূজায় তাঁর পোষ্ট করা মুটিয়ে যাওয়া ছবি দেখে জেনেছি। রঞ্জনা-এখন ইরানী বোরখা পরে । প্রায় প্রতি বছর হজ্ব করতে যায় । বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রাখা বরুণা’র সম্প্রতি ব্রেস্ট ক্যানসার ধরা পরেছে । সবচেয়ে অবাক হই অনির্বাণকে দেখে । দিন বদলের সংগ্রাম করতে করতে ক্লান্ত হয়ে মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে আয়েশি ভঙ্গিতে তোলা ছবি দেখে লিখে দেই, বাহ তুইতো ভালোই আছিস অনির্বাণ ।

জীবনের কফি হাউস, রাস্তার ধারের সস্তা হোটেল, আবুলের দোকান, বাবুলের ছাঁদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডায়-ঝগড়ায় কাটিয়ে দেয়া বন্ধুরা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ । যেই সময় যে বন্ধুর সাথে হাতে হাত ধরে, চায়ের কাপ আধাআধি করে কাটিয়ে দিয়েছি সেই সময়কে কোনদিন অস্বীকার করতে পারবোনা । সেই সময়টাই জীবনের সম্পদ ।

জীবনের বিভিন্ন পর্বে যে বন্ধুরা প্রায় প্রতিদিনের সূর্যের মত সত্য ছিল আজকাল তাঁদের অনেকের সাথেই চলছে গ্রহণকাল । এক শহরে থেকেও দিনের পর দিন মাসের পর মাস চলে যায় দেখাও হয় না, কথাও হয় না । নাই হোক, একসময়তো পেটের ভাত হজমের জন্য এই বন্ধুরা অপরিহার্য ছিল । আমি সেই সময়ের কথা মনে করি । এই সময়েও জীবনের চলমান বাস্তবতায় নতুন নতুন বন্ধু জোটে যায় । শৈশব কৈশোর বা যৌবনের মত এই বন্ধুত্ব হয়তো এক কাপ চা ভাগাভাগি করে খাওয়ার মত নয়, কিন্তু জীবনের অবসাদ, অভিজ্ঞতা ও নান্দনিকতাকে ভাগাভাগি করে নেয়া যায় এই বন্ধুতায় ।

 

লেখাটি গত শুক্রবার (৯ জুন) দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার উত্তর আমেরিকা সংস্করণের ২৯ নং পাতায় প্রকাশিত হয়েছে ।