নিজের গায়ের রঙ এ লজ্জার কিছু নাই - Women Words

নিজের গায়ের রঙ এ লজ্জার কিছু নাই

যাহিয়ান ফাতিমা মাইশা

আমি কালো। অনেক কালো। ছবিতে যেমন দেখাচ্ছে হয়তো তারচেয়েও একটু বেশি কালো। গায়ের রঙ নিয়ে হীনমন্যতা সবসময়ই ছিল। অনেকের কাছে অনেক খোঁটা শুনেছি। মনে আছে স্কুলে থাকতে একটা মেয়ে “কাল্লু” বলেও ডাকতো। ক্লাস সেভেনে থাকতে এক টিচার সবার সামনে অপমানও করেছিলেন। চুল কোঁকড়া বলে রাস্তাঘাটে ‘নিগ্রো, আফ্রিকান” বলে টিজ শোনাটা তো এখনও ডেইলি রুটিন আমার জন্য। আত্মীয়স্বজন অনেকেই ‘এইটা খেলে ফর্সা হবা, ওইটা ডেইলি খাইলে উজ্জ্বল হয়ে যাবা’ এরকম অনেক উপদেশ দিয়েছে।

সারাজীবন বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বহু ক্রিম মেখেছি। অনেক কম বয়স থেকেই (বুড়া হয়ে যাই নাই, মাত্র অনার্স শেষ করেছি এই বছর) এই ক্রিম, সেই সাবান মাখতাম। আমার বড় বোনের আবার সেই চেষ্টা ছিল না। এই পাউডার, ওই চন্দন মেখে হাস্যকর রকমভাবে মুখ সাদা করে বাইরে যেতাম। কত চেষ্টা একটু ফর্সা দেখানোর! কত লজ্জা এমন রঙ পাওয়ার জন্য! গায়ের রঙ লুকানোর কত শত চেষ্টা! কখনো খুশি ছিলাম না। গায়ের রং নিয়ে কখনো প্রাউড ফিল করি নাই। কুৎসিত মনে হত নিজেকে। কোন ছবিতে একটু ফর্সা দেখালে ‘ছবি ভালো হয়েছে’ বলে লাফঝাঁপ দিতাম। কিন্তু মাসখানেক যাবৎ এই জাতীয় চিন্তা মাথা থেকে চলে যাচ্ছে। দুইটা কারণে-

১. আমার বড় বোনের জন্য। ও আমাকে অনেক কিছুতে অনুপ্রেরণা দেয়। ও যা বলে আমি তার ঠিক বিপরীত কাজটাই করি। তবে ওর পার্সোনালিটি, কাজ কর্ম থেকে আমি অনেক কিছু শিখি (যদিও আমি  ওর কাছে তা স্বীকার করি না )। ওর বিয়ের সময় বলল যে ও রূপার গহনা পড়বে, ন্যাচারাল সাজ দিবে। তেমন পাত্তা দেই নাই। আমার একমাত্র বড় বোনের বিয়ে, পার্লারে গিয়ে সাদা ভূত সাজলাম। কিন্তু কমিউনিটি সেন্টারে যেয়ে যখন ওকে বউ সাজা অবস্থায় প্রথম দেখলাম তখন ১ মিনিটের জন্য হ্যাং হয়ে গিয়েছিলাম। একটা মেয়ে, একটা কালো মেয়ে বউ সাজলে যে এত্ত রূপবতী লাগতে পারে তা আমার জানা ছিল না। নিজের গায়ের রঙেও যে আমি সুন্দর সেটা ওকে দেখে মনে হয় আমি প্রথম উপলব্ধি করেছি। নিজের গায়ের রঙ এ যে লজ্জার কিছু নাই এটাও ও আমাকে চোখে আঙুল তুলে দেখিয়েছে। ও যে আমার মধ্যে কতখানি কনফিডেন্স এনে দিয়েছে তা ও নিজেও জানে না।

২. এক্স-এর কারনে। ছেলেটা ফর্সা। আমার বোনের বিয়েতে যখন ওর মা-বাবা আমাকে দেখল, তখন তাদের এক্সপ্রেশনেই বুঝেছিলাম তারা আমাকে পছন্দ করে নাই। বরাবরই আমি তাদের অপছন্দের ছিলাম। কারন একটাই- আমি কালো। কালো মেয়ে তারা ঘরে তুলবেন না। (বলাই বাহুল্য, তার মা নিজেও কালো!)। এমনকি ওর মা নাকি এই কথাও বলেছে “মেয়ের ফ্যামিলি ভাল, সব ভাল। শুধু গায়ের রংটা যদি ফর্সা হত!” তারা আমাকে এই কারনে রিজেক্ট করে দিল। ছেলেটা আমাকে জানালো, তার কিছু করার নাই, কারন তার পরিবার যেই রিজন দেখিয়েছে সেটা তো আর চাইলেই পরিবর্তন করা যাবে না, তাই এখানে সে কিছুই বলতে পারবে না। গেল ব্রেকাপ হয়ে। মাসখানেক পরে সে আবার আসলো আমার কাছে। তার ফ্যামিলিকে রাজি করাবে বলল। যেহেতু এখনই বিয়ে করার প্ল্যান নেই তাই সে ধীরেসুস্থে রাজি করাবে বলল। কিছুদিন পর থেকে সে বলা শুরু করল “তুমি এটা করতে পারো, সেটা হতে পারো, তুমি এটা হলে বা আমরা একসাথে কোন বিজনেস করলে তখন বাসা থেকে মানবে” এমন-তেমন হাজার কথা। সব কথার যেন একটাই অর্থ ‘তুমি কালো, এটা তোমার কিছু একটা হয়ে ঢাকতে হবে’। আমার গায়ের রঙ হাজারভাবে চাপা দিয়ে, অনেক কিছু করে, প্রমান দিয়ে তারপর তার বউ হওয়ার যোগ্যতা আমার হলেও হতে পারে এমন একটা ব্যপার। সটকে পড়লাম। আমাকে কেন ‘কিছু একটা’ হয়ে গায়ের রঙ সামাল দিতে হবে? আর যেই মানুষ আমার গায়ের রঙ নিয়ে লজ্জিত সে কেমন করে আমার সাথে সংসার করবে?

বুঝলাম – নিজে যতদিন রঙ নিয়ে মন ছোট করে থাকব- ততদিন আমারই ক্ষতি, দুনিয়া এসে আমাকে উদ্ধার করে যাবে না। অন্য কেউ ভালবাসার আগে নিজেকে নিজের ভালবাসতে হবে। দু’টা ঘটনাই রিসেন্ট। জুলাই থেকে আমার এই উপলব্ধি শুরু। এরপর থেকে নিজের প্রতি ভালোবাসাটা বাড়ছে, নিজেকে নিয়ে মন খারাপ লাগাটা কেটে গিয়েছে। নিজেকে এখন অনেক সুন্দরও লাগে। সৃষ্টিকর্তার কাছে লাখো-কোটি শুকরিয়া আমাকে এত সুন্দর করে সৃষ্টি করার জন্য। আমি সাজতে পারি না ভালো, ইদানিং কাজল দিয়েই নিজেকে অনেক সুন্দর মনে হয়। মুগ্ধতাও বাড়ছে নিজের প্রতি (শুনতে অদ্ভুত লাগলেও কথা খুবই সত্যি) ) আমি জানি যে কালো রঙ নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগা একমাত্র বাঙালী মেয়ে আমি না। আমার মত আরো কোটিখানেক মেয়ে আছে। তাই ইচ্ছে হচ্ছিল নিজের উপলব্ধিটা শেয়ার করতে।