ধূসর পথের বাঁকে ... - Women Words

ধূসর পথের বাঁকে …

অনন্যা হক

কেমন আছিস শ্রাবণী? কি রে চিনতে পারছিস না, ভুলে গেছিস চেহারা? দরজায় দাঁড় করিয়ে রাখবি, দরজাটা পুরো খোল, ভেতরে গিয়ে বসি।

শ্রাবণী দরজা টা খোলে। এই প্রথম  মাধবী তার প্রাণের বন্ধু, শ্রাবণীর সংসারে পা রাখলো। শ্রাবণী মাধবীকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলো বুকে। যেন বিশ বছরের ভালবাসা আর ত্রিশ বছরের দূরত্ব আর বিরহের উত্তাপ ছড়িয়ে গেল শরীর আর মনে।

এতক্ষণে কথা বলে শ্রাবণী, সত্যি তোকে চিনতে একটু কষ্ট হয়েছে।তুই কি আর আগের মত আছিস নাকি?

-কেমন করে আগের মত থাকি, আজ ত্রিশ বছর পরে দেখা তোর সাথে। এই ত্রিশ বছরে কত জল, কত ঢেউ গড়িয়ে গেল বল!

-কোথায় পেলি আমার ঠিকানা?

-তোর বোনের সাথে আমার কথা হয়, তোর খোঁজ রাখি আমি। তোর মত সব মুছে ফেলতে পারিনি আমি। ওর কাছেই শুনলাম, তুই ফিরে এসেছিস আবার আমাদের শহরে।তখনই ঠিক করেছি, এবার বাড়িতে এসে তোর কাছে আসবোই।

শ্রাবণী বোঝে মাধবীর অভিমান।বলে, তুই তো একটা বাঁধ ভাঙা জোয়ার। আর আমি বাঁধ ভেঙেছি জীবনে একবার, তারপর থেকে নিজের ভেতরে থিতু হয়ে বসে রইলাম, শুধু মাত্র একজন মানুষ কে ঘিরে। বড্ড ভুল করে ফেলেছি রে, অনেক কিছু হারিয়েছি, যা অনেক হা পিত্যেশ করেও আর খুঁজে পাচ্ছি না।

মাধবী শ্রাবণীর কথা শুনছিল, মুখের দিকে তাকিয়ে। দেখলো সেই ছটফটে বন্ধু, যাকে সাথে নিয়ে, দুজনে ফ্রক পরে, বেণী দুলিয়ে, সারা এলাকার মাঠে ঘাটে, বনে, বাদাড়ে ছুটে বেড়িয়েছে, আজ কত ধীর স্থির, একটা বিষন্ন ক্লান্ত চেহারার রমনী ।

মাধবী বলে, এমন করে বলছিস কেন?

-থাক এসব কথা পরে বলবো। এই গরমে কষ্ট করে এলি, ভর রোদ মাথায় নিয়ে, ঘেমে নেয়ে এক সার। বল কি খাবি, একটু বোস, আমি খাবারের ব্যবস্থা করি বলে উঠতে যায় শ্রাবণী।

মাধবী হাত টা ধরে টান দেয়, বোস এখানে, আমি ভর পেটে এসেছি, আজ শুধু কথা বলবো, অনেক জমানো কথা ।

-দ্যাখ না ঠিক  আগের মত, এই দুপুর টা বেছে নিয়ে  তোর কাছে এসেছি। কেন জানিস, এই বর্তমানের ভেতরেও অতীত খুঁজে পাওয়ার  আশায়। শুধু একটু চা খাব সন্ধ্যায় তোর সাথে।

আবার তোর অখিল এসে জ্বালাবে না তো?

-তুই তো কথায় তেমনই আছিস, এখনও এত প্রাণ পাস কোথায়?

-কেন নিজের সাথে থেকে, তুই থাকিস না? আমি তো  না দেখেও তোকে দিব্য চোখে দূর থেকে দেখতে পাই।সব আস্তে আস্তে চলে যেতে থাকে নদীর স্রোতের মত, হাজার টা স্মৃতি বুকের ভেতর ডানা ঝাপটাতে থাকে। বড্ড কষ্ট হয় সব ছেড়ে দিতে, পারি না। তাই ফিরে ফিরে দেখি, নিজের সাথে থাকি, তখন প্রাণ ফিরে আসে। তাই তো তোর কাছে ছুটে এলাম। তুই তো একবারও খুঁজলি না আমাকে!

মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে মাধবীর কথা শুনছিল শ্রাবণী। একটু মৃদু হেসে বলে, কে বললো তোকে খুঁজিনি, মনে মনে আতিপাতি করে খুঁজেছি, এখনও খুঁজি। কত কথা বলার আছে তোকে আমার!

-এবার বল তোর অখিল কই, তাকে দেখার বড় সাধ আমার। সে কেমন রাজপুত্র, যাকে পেয়ে পরিবার ছেড়ে,  আমায় একা ফেলে পালিয়ে চলে গেলি?

বন্ধুর  উচ্ছ্বলতায়  শ্রাবণীও যেন একটু প্রাণ ফিরে পায়, মনে কিছুটা ভাল লাগা শুরু হয়, যেন একেবারে শুকিয়ে যাওয়া নদীতে কোথা থেকে একটা পানির প্রবাহ শুরু হলো, ছোট্ট করে ঢেউ উঠলো!

অভিমানী উচ্ছ্বল বন্ধু কে বললো, এজন্যই তোকে আমি একই রকম ভালবাসি, মনে মনে খুঁজি। শুধু নিজের কাছে হেরে গেছি, তাই ছুটে বের হতে পারিনি।

-তোর সব মনে মনে? প্রেম ও তো করেছিলি না জানিয়ে, মনে মনে রেখেছিলি। তোর চোখের নীচে কালি কেন? সেই ভাসা ভাসা চোখের মেয়ে তুই, কেউ একজন খুব পাগল ছিল। অখিলও তোর এই চোখেই মজেছিল, বলেছিলি একদিন। এবার বল কেমন ছিলি , কেমন করে কাটালি এত গুলো বছর?

শ্রাবণী ভেবে পায় না কি বলবে, কিন্তু  আবার ভাবে,  এই মাধবীকেই তো সব বলা যায়। তার তো দম আটকে আসে, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। সে তো একজন বলার মানুষ খুঁজছে। বলে, শুনবি আমার জীবনের কথা, আমার অখিলের গল্প?  তোর শুনতে ভাল লাগবে না,  তবুও বলবো।

মাধবী একটু গম্ভীর হয়, তার উচ্ছ্বলতা মিইয়ে আসে ।

শ্রাবণী বলতে শুরু করে, অখিল এখন অন্য নারী তে আসক্ত। এমন কি তাকে বিয়ে করতেও প্রস্তুত। আমার মুখের উপরে বলে, আমার কিছু করার নেই, তোমাকে আমার দরকার নেই, বলে ডুকরে কেঁদে ওঠে।

মাধবী চমকে ওঠে, বিশাল একটা ধাক্কা খায়।বলে, তোর মুখের উপরে বলে এ কি করে সম্ভব ?

হাতে হাত রাখে শ্রাবণীর। কি বলবে খুঁজে পায় না, ভাবে এসব শুনবো বলে এসেছি? কত জমানো গল্প, কত স্মৃতির বন্ধ ডালি খুলবে দুই বন্ধু আজ, হাসবে, ছোট ছোট সুখ দুঃখ শেয়ার করবে।একদম চুপসে গেল মাধবী।

বললো, কতদিন ধরে চলছে এসব?

-আজ তিন বছর। সংসার তো নয়, যেন একটা দাবানলে জ্বলছি আমি ।

-এর প্রতিকার কি,  কি করবি ভাবছিস? তোর একটা চাকরি তো আছে। তোর একটা ছেলে আছে, শুনেছি বড় হয়েছে।

-আমি তো পুড়ে পুড়ে এখন ছাই।তবুও যুদ্ধের শেষ দেখতে চাই। শুধু শেষ দেখার জন্য আছি,  তার কাছে আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। ওর জন্য  আমি  সব ছেড়েছিলাম। এক বুক হাহাকার ছিল, বাড়ি, বাবা মা, ভাই বোন, তুই,  এই শহর, সব কিছুর জন্য। তবুও ভালবাসা আর সংসারের মোহে আমি ডুবে ছিলাম। আজ যখন সব ঠিক হয়ে গেল, ঠিক  তখন সে আমাকে  আগুনে ছুড়ে ফেলে দিল।

-এ ভাবে  বাঁচতে পারবি?

-কি করবো বল, ওর নীচে নামার শেষ পর্যন্ত আমি কাছে থেকে দেখতে চাই।সে ই পারলে

আমাকে বিদায় দিয়ে চলে যাক।

শ্রাবণী বলে, এখন ঝোঁকের মাথায় কিছু করার বয়স নেই। ঝোঁকে পাগল হয়ে, বোধ বুদ্ধি হারিয়ে ঐ বয়সে করেছি, যা  ইচ্ছা তাই। এখন  পরিণত বয়স, আবেগের মধ্যে অনেক যুক্তি এসে ভর করে। এখন  আমার  অখিলের সাথে  অন্য হিসাব নিকাশ বাকী। সব থেকে  আগে  আমার ছেলের ভবিষ্যত ঠিক করতে হবে আমাকে।আমার ছেলের জীবনের  এখনও  অনেক পথ বাকী।তার বাবা দরকার। এগুলো কঠিন হিসাব মাধবী। দুজনে মিলে অনেক কিছু করেছি টাকা, জমি, বাড়ি, গহনা, সব বুঝে নিতে হবে নিজের জন্য, ছেলের জন্য। অন্য কাউকে ঘরে নিয়ে তুললে,  আমাকে বা আমার ছেলেকে চিনবে?এ বড় কঠিন হিসাব রে মাধবী, বলতেও লজ্জা লাগে, ভাবিনি কখনও এসব হিসেব আমাকে করতে হবে। আগে তো কখনও নিজের দিকে তাকিয়ে দেখিনি, সব বিশ্বাস করে একসাথে করেছিলাম, নিজের চাকরির টাকা দিয়ে। জানিস এত রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা,  তবুও কোথা থেকে যেন, আবার এই পোড়া মনে, হাজারটা সুখ স্মৃতি,  এক ছিটে মায়া, ঐ লোক টার জন্য, মনের কোণে উঁকি দিয়ে যায়, মাঝে মাঝে। এ কেমন জ্বালা  বল তো?

মাধবী বেশি কথা বলে না,  শুধু শুনেই যায়।মনে মনে ভাবে, নিজের কোন কথাই সে আজ বা কোনদিন ওর কাছে আর তুলবে না।এরপর কি আর কোন কথা থাকে,  ওর পাশে দাঁড়ানো ছাড়া?

মাধবী জানলো জীবনের আরও একটি বাঁকের গল্প। যে বাঁকে খুব কাছের এক মানুষ পথ হারিয়ে ফেলেছে।

মাধবী জানলো, শিখলো, শুধু ঝোঁক, অভিমান, জেদ এসব আবেগ দিয়ে জীবন চলে না।আরও  অনেক প্রখর হিসাব নিকাশ এর যুক্তি, জীবনের পড়ন্ত বেলায়, পথের বাঁকে বাঁকে দাঁড়িয়ে থাকে।সে শুনতে থাকে গভীর মনোনিবেশে শ্রাবণীর কথা, বুঝতে থাকে। শ্রাবণী বলে যায়,  তার জীবনের অন্ধকার চোরাগলির গল্প।

এক সময় সে থামে, বলে, আমার কথা বলতে বলতেই সময় টা শেষ করে দিলাম। তুই বোস,

আমি একটু  চা বানিয়ে আনি।শ্রাবণী  উঠে যায় ।

মাধবী বসে, তার বন্ধুর সুখী গৃহকোণে চোখ বুলিয়ে যায়। কিন্তু অসুখের কোন চিহ্ন সে খুঁজে পায় না, যা লুকিয়ে রেখেছে শ্রাবণী তার মনের সিন্দুকে।

এর পর দুজনে মিলে চা খায়। হয় না একটুও স্মৃতি চারণ, একটুও হাসাহাসি।এবার বিদায়  নেয় মাধবী। একটু হেঁটে চেনা পথ ধরে শ্রাবণী মাধবী কে বিদায় দিতে যায়।

মাধবী বলে,  আজ আসি রে, আবার কোন এক দিন  আসবো। তুই  যোগাযোগ রাখিস, সেল নম্বর তো থাকলোই। চেষ্টা করিস ভাল থাকার।

দুই বন্ধু দুই পথের বাঁকে মিলিয়ে গেল, নিজেদের ঠিকানার উদ্দেশ্যে।