জীবনের নতুন অধ্যায়... - Women Words

জীবনের নতুন অধ্যায়…

রিংকি সাহা

আমি বুঝিনা বিয়েতে কেন একটা সাধারণ হালকা শাড়ি পড়া যায়না! এই এত্ত বড় বেনারসি সামলাতে আমি রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছি। তার ওপর এই মঞ্চে আমাকে মধ্যমণি হিসেবে রাখা হয়েছে। প্রত্যেকটা লোক ড্যাবড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে আমি একখানা সাজানো গোজানো শোপিস। মাঝেমাঝে দু একজন মঞ্চে এসে উপহার দিয়ে যাচ্ছে। এই গরমে বেনারসি সামলিয়ে মুখে হাসি দিয়ে সবাইকে ধন্যবাদ জানানোর ঝক্কি কতোখানি সে আমি হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি।

ও দুঃখিত, আমি সিঁথি। আজ আমার বিয়ে। বাবা মায়ের মতেই বিয়ে হচ্ছে। হুম খুশি! শাড়ি ঠিক করছি- হুট করে চোখ আটকে গেল মঞ্চে কে উঠলো? শুভেন্দু দা? হ্যা তাই তো।

_ কেমন আছো শুভেন্দু দা ওহ সরি কেমন আছেন?

_ কি রে পাগলি তুই আমায় তুমি করে বলতি আজ দেখি ঘটা করে আপনি বলা হচ্ছে হু?

_ না আসলে অনেকদিন পর দেখা তাই। বৌদি আসেনি?

_ হ্যা এসেছে ওইদিকে আছে মেয়েটাকে খাওয়াচ্ছে।

আমি হুট করে ভাবলাম শুভেন্দু দার তাহলে মেয়ে হয়েছে। বাহ! নিশ্চিত পুতুলের মতোন হবে। শুনেছি বৌদি বেশ সুন্দরী আর শুভেন্দু দার কথা কি বলবো সে তো ফার্স্টক্লাস সুদর্শন।

_ কি রে কি ভাবছিস?

_ না কিছুনা আপনি খেয়েছেন? না খেলে খেয়ে নিন।

_ বাহ রে বিয়ের আগেই পাঁকা গিন্নি হয়ে গেছিস হু?

আমি যেন কল্পনায় আমার ছোটবেলায় চলে গেলাম। শুভেন্দু দা। আমাদের আবদুল্লাহ স্যারের কথা মতো আমাদের স্কুলের একমাত্র হিরের টুকরো। তখন আমি ক্লাস ফোরে আমার রোল পাঁচ। আবদুল্লাহ স্যারটা কেমন অদ্ভুত ছিল! ক্লাসে পড়া না হলেই শুভেন্দু দার কথা তুলতো। অন্য স্যাররা আমাদের ক্লাসের ফার্স্টবয় অতুলের কথা বলতো আর আব্দুল্লাহ স্যার আমাদের চেয়ে চারক্লাস ওপরের কে না কে শুভেন্দু তার কথা তুলতো আমার ভীষণ রাগ হতো। তখন আমি শুভেন্দু দা কে চিনতাম না তবু হিংসে হতো খুউব।

আমার দাদা সেসময় অন্য স্কুলে পড়তো। ক্লাস নাইনে আমাদের স্কুলে ভর্তি হলো। আর কিভাবে কিভাবে যেন শুভেন্দু দার সাথে আলাপ এত্তো গভীর হলো যে ওরা গলায় গলায় বন্ধু হয়ে গেল। সেই সুবাদে আমাদের বাসায় আসতো।

কতোবার রাস্তায় দেখে ছাদ থেকে ঢিল ছুড়েছি তার ইয়ত্তা নেই একবার তো কেলেঙ্কারি হয়ে গেল রক্ত বের হয়ে গেল! সেরাতে দাদা আমার গায়ে হাত তুলেছিল শুভেন্দু দার জন্য। আরো ক্ষেপে গেছিলাম। পরদিন শুভেন্দু দার চায়ে চিনির জায়গায় লবন দিয়েছিলাম এরপর দাদা আর শুভেন্দুদা কে লজ্জায় বাড়ি আনেনি।

দুবছর পর দাদাদের বিদায় অনুষ্ঠানের দিন আবদুল্লাহ স্যার শুভেন্দু দাদাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলো আর বলেছিল “শুভেন্দুর মতো ভাল ছেলে, ভাল ছাত্র পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার আমি একটাই পেয়েছি। তোমরা আমায় সে ভাগ্যের স্বাদ আরেকবার দিতে চাইলে শুভেন্দুর মতো হও”।

সেদিন থেকে অন্য রকম এক ভালোলাগা শুরু হলো। আমিও স্যারদের এমন ভালবাসা চাই। আমিও শুভেন্দু দার মতো হতে চাই। কিভাবে কিভাবে যেন শুভেন্দু দা আমার আদর্শের জায়গাটা নিয়ে নিলো।

শুনেছিলাম, শুভেন্দু দাদার বাবার অবস্থা ভাল ছিল না আর তাই জন্যই এস এস সি এর পরেই উনি টিওশনি করাতেন। আমি তখন সেভেনে। দাদার কাছে বায়না করলাম আমি শুভেন্দু দাদার কাছে পড়বো। কারণ আমি ভেবেই নিয়েছিলাম আমাকে শুভেন্দু দার মতো হতে হলে সবচে সহজ রাস্তাটা একমাত্র সেই আমাকে শেখাতে পারবে। দাদা তো প্রথমেই না করে দিলো যাকে ঢিল মেরে রক্ত বের করে দিলি, যার চায়ে লবন গোলালি তুই তার কাছে পড়তে চাইছিস লজ্জা করেনা? আমার একটাই কথা পড়তে হলে তার কাছেই পড়বো নতুবা না। অগত্যাই দাদাকে মেনে নিতে হলো। কিভাবে জানি না শুভেন্দু দাও রাজি হয়ে গেছিলো।

প্রথম প্রথম খুব বুঝতাম সে আমায় ভয় পেতো। আবদুল্লাহ স্যার ভুল বলতেন না তার মতোন ভদ্র ছেলে আরেকটা পাওয়া মুশকিল আছে। অল্পদিনেই আমরা সহজ হয়ে গেলাম। সে আমাকে জানিয়ে দিলো আমি যেন তাকে স্যার না বলে দাদা ডাকি আর তুমি করে বলি আপনে আজ্ঞেতে তার পোষায় না।

উনি আমার আদর্শ ছিলেন আগেই তবে কবে যে সেই আদর্শ ভাললাগার পর্যায়ে চলে গেল বুঝিনি। শুভেন্দু দা না আসলে আমার মন খারাপ হতো।

তখন আমি সবে ক্লাস নাইন। ক্লাসে প্রেম নিয়ে কানাকানি। আমি নিজেও জানিনা বান্ধবীদের জোড়াজুড়িতে আমি শুভেন্দু দার নাম নিলাম। নাম নিয়ে নিজেই আশ্চর্য হলাম! সাথে লজ্জাও পেলাম কি অদ্ভুত শুভেন্দু দা আমার প্রথম প্রেম? সেইরাত সারারাত ঘুম হয়নি।

তারপর দিন থেকেই শুভেন্দু দা কে দেখলেই অন্যরকম শিহরণ কাজ করতো। খাতা দিতে গিয়ে কিংবা বই কলম দিতে গেলে আঙুল ছুঁয়ে গেলে কেঁপে উঠতাম। একদিন তো দাদা বলেই উঠলেন,
“কি রে সিঁথি কি হয়েছে তোর? পড়ালেখায় মন নেই সবসময় কি এক অন্য চিন্তায় থাকিস মনে হয়? বল তো সমস্যাটা কি?”

আমিও ঘাবড়ে গিয়ে বললাম,
“কই কিছু না তো।”

তারপর থেকেই সমঝে চলতাম। অংক করার ফাঁকে শুভেন্দু দার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকানোটা কমলো ঠিকই ভেতরের শিহরণ কমেনি!

টেস্ট পরীক্ষার পর আমি একদিন রাস্তা আগলে শুভেন্দু দা কে বললাম ভালবাসার কথা। সে তেমন কিছু বললোনা শুধু বললো,
“ভাল করে পরীক্ষাটা দে। ওসব আলোচনা পরে হবে”
আমার সে কি খুশি। শুভেন্দু দা নিষেধ করেনি এর মানে সেও নিশ্চিত আমায় ভালবাসে। কথা রাখতে হবে, পরীক্ষাটা ভাল করে দিতে হবে। জোড়সোড় ভাবে লেগে গেলাম।

পরীক্ষা শেষে রেজাল্ট বের হওয়ার দিন। অনেক দিন পর সেদিন শুভেন্দু দার আসার কথা ছিল। আমি ভীষণ উত্তেজিত ছিলাম আজ আমার দুটো রেজাল্ট। পরীক্ষার টা নিয়ে নিশ্চিন্ত আমি জানি আমার রেজাল্ট ভালই হবে আর শুভেন্দু দা? আমি সেদিন শাড়ি পড়েছিলাম। রেজাল্ট দিলো গোল্ডেন এ প্লাস। আমি দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম কখন শুভেন্দু দা আসবে। আসেনি!! সন্ধ্যায় দাদাকে জিজ্ঞেস করাতে সে বললো, শুভেন্দু দাদা নাকি পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে ঢাকা গেছে তার নাকি চাকরি হয়েছে। দাদা আমাকে র‍্যাপিং এ মোড়ানো একটা গিফট দিয়ে বললো,
“নে তোর আমানত। শুভেন্দু বলেছিল, তোর রেজাল্ট বের হলে তোকে এটা দিতে।!”

আমি গিফট বাক্সটা দাদার হাত থেকে ছো মেরে দৌড়ে নিজের ঘরে গেলাম। ভেতরে একটা ডায়েরি একটা কলম। ডায়েরির ভাজে একটা চিঠি।

প্রিয় সিঁথি,
আমি জানি আমার ছাত্রী এতো নড়বড়ে না সে ভাল রেজাল্ট করবেই। তাই আগেই তোর উপহার তৈরি রেখেছিলাম। চাকরির জন্য ঢাকায় যেতে হচ্ছে। শোন, এবার রাস্তাটা আরো কঠিন হলো। এই রাস্তাটাতে আমি তোর পাশে থাকতে পারবোনা। এবারকার লড়াইটা তোকেই লড়তে হবে। ভাল করে পড়ালেখা করবি। তোর এই দাদাটার মুখ উজ্জ্বল করবি। আমি তো আর পড়ালেখাটা করতে পারলাম না তুই করিস। আর শোন, তুই এখন অনেক ছোট। সেদিন রাস্তা আগলে যেটা বলেছিলি সেদিন উত্তর দিইনি দিলে তুই পরীক্ষাটা ঠিকঠাক দিতে পারতিনা। আজ দিই আমি তোকে ওই চোখে কখনোই দেখিনি। জীবনটা সবেমাত্র শুরু। সব ভাললাগা কে ভালবাসার নাম দিস না পাগলি! দেখবি তোর জীবনে খুব ভাল কেউ আসবে। সেদিন টা তোর আফসোস হবে বয়সের দোষে কি ভুলটাই না করতে যাচ্ছিলি যাকগে সেসব ভাল থাকিস। বাড়ি এলে দেখা করবো। পড়ালেখাটা ভাল করে করিস।

ব্যাস এত্তোটুকু চিঠি! আমি সেদিন খুব কেঁদেছিলাম। বাড়িভর্তি লোকজন রেজাল্ট শুনতে এলো। চারদিক মিষ্টির গন্ধে মো মো আর আমি দরজা লাগিয়ে কাঁদছি!

শুভেন্দু দা ঠিক বলেছিল কিনা জানিনা। তবে সাত বসন্ত পার হয়ে গেছে আমার জীবনে আর প্রেম আসেনি। কাউকেই ভাল লাগেনি, যতোটা শুভেন্দু দা কে লেগেছিল। প্রেম শব্দাটা মাথায় আসলেই আমার চোখে শুভেন্দু দা ভর করে।

_ সিঁথি চল এবার শুভদৃষ্টির জন্য যেতে হবে। তুই এই পিড়িটাতে বোস আমি আর সুধেনদা তোকে নিয়ে ছাদনাতলায় নিয়ে যাচ্ছি।

দাদার কথায় সম্বিত ফিরে পেলাম। শুভদৃষ্টির সময় শুভেন্দু দার দিকে একবার তাকালাম তার কোলে তার ছোট্ট পরি, ইশ কত্তো সুন্দর হয়েছে মেয়েটা। মালাবদলের সময় আরেকবার তাকিয়েছিলাম তখন শুভেন্দু দা বৌদির কাধে হাত রাখলো। নাহ আর না, আজ থেকে আমার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু। শুভেন্দু দা আমার প্রথম প্রেম আজ থেকে তার ইতি ঘোষণা করলাম।

 

লেখকের আরেকটি লেখা

আপনার লোম দাঁড়ায় নারী শরীর দেখে, পোশাক দেখে নয়