কাব্য লিখনের গল্প - Women Words

কাব্য লিখনের গল্প

রাহিমা বেগম

কি ব্যাপার, চা যে ঠান্ডা হচ্ছে?
ওহ!
খুব খুশি মনে হচ্ছে?
হুম!
কি ব্যাপার বলতো?
বলব, তার আগে বলো কতদিন আমরা দূরে কোথাও ঘুরতে যাইনা?
সে তো অনেকদিন। এখন তো আগষ্ট মাস। পুরো আট মাস!
এই বছর কোথাও ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছে না?
করছেনা আবার! এত কাজের চাপ। একটু ঘুরে আসতে পারলে ফ্রেশ লাগত।
আগামি সপ্তাহে ছুটি নিতে পারবে? আমি আজকে মোটামোটি প্ল্যান করে অফিসে এসেছি, পুরা সপ্তাহের ছুটি নিব। ইচ্ছে আছে ভারত ঘুরে আসার।
সত্যি! ভালো হবে তাহলে।
তুমি ছুটি নিতে পারবে?
কেন পারবনা, আমার অনেকগুলো কম্পেনসেসন লিভ ই আছে।
খুব ভালো! কাল অফিসে গিয়েই ছুটির ব্যাপারে আলাপ করে নিও।
এই শুনো, সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখ আমার একটা ওয়ার্কশপ আছে। তাই অন্তত ৭-৮ তারিখের মধ্যে ফিরতে হবে। আর প্রোগ্রামের টেনশন মাথায় নিয়ে গিয়ে ঘুরেও আনন্দ পাওয়া যাবেনা।
তাহলে কি করা? ট্যুর বাতিল?
নাহ!
কি করা?
একটা বুদ্ধি আসছে!
কি?
আচ্ছা পুরো ভিজিটের প্ল্যান যদি আমি করি তবে তুমি কি ভরসা ভরসা রাখতে পারবে?
কেন নয় ? লিখন তুমি জান যে তোমার সাথে চোখ বন্ধ করে পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে আমি যেতে পারি।
তাই?
হুম তাই। তাছাড়া তোমার চিন্তা সব সময় অনেক ইনোভেটিব হয়! তুমি যদি প্ল্যান করো নিঃসন্দেহে সেটা অন্যরকম হবে।
তুমি কি আগামি বুধবার থেকে ছুটি নিতে পারবে?
দাড়াও, এক মিনিট। বুধবার কত তারিখ?
২ তারিখ। পারব।
কত দিনের ছুটি লাগবে?
বুধবার গিয়ে শনি রোববার নাগাদ চলে আসব।
কোথায়?
কিছুই বলবোনা। তুমি শুধু আমার সাথে যাবে।
Wow! Feeling very excited!
Me too. Let me make a phone to ensure our visit.
তুমি এনসিওর হও, আমি একটু নীচ থেকে ঘুরে আসি।
ঠিক আছে যাও, তবে দেরী কর না।
কাব্য, শোন এখন থেকে শুরু করে বেড়ানো শেষ করে বাসায় ফিরার দিন রাত পর্যন্ত তোমার বাসায় সিগারেট খাওয়া allowed.
That’s like a sweet girl.
আমি নীচে যাব আর আসব! কাব্য দরজার সামনে গিয়ে আবার ফিরে আসলো।
কি ব্যাপার যাবে েনা?
যাব, একটা কথা বলব।
বলো।
লিখন, তোমার কাছে আমি কখনও কোন আবদার করতে পারিনা?
লিখনের হাসিটা মিলিয়ে গেল, হঠাৎ এই কথা! তুমি কোন আবদার করেছ আর আমি শুনিনি এমন হয়েছে কখনো। তোমার কত অন্যায় আবদার ও কত মেনে নেই।
কাব্য দেখলো লিখনের গলা ভারি হয়ে আসছে, চোখের কোণায় পানি। লিখনকে কাছে টেনে নিয়ে কপালে একটা চুমো দিয়ে বলল, আমি কি তোমাকে তাই বললাম?
লিখন এইবার একটু সাহস পেল, কাব্যের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো তাহলে এই কথা বললে কেন?
বোকা মেয়ে পুরোটা শুনবে তো!
কন্ঠ পরিবর্ত ন হলো,আদুরে গলায় বলল, বলো তাহলে কি বলতে চাইছ।
আমি কি কখনো তোমার কাছে আবদার করার সুযোগ পাই? আমি বলার আগেই তো তুমি সব বুঝে নাও।
যাও! ঢং করতে হবেনা। আমাকে তো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।
কাব্য লিখনের চোখের পানিটা মুছে দেয়। এই মেয়েটা যদি আমার জীবনে না আসত, তাহলে হয়ত জীবনের মানেটা কি আমি হয়ত কোনদিনও বোঝতে পারতাম না।
শোন তুমি বুধবার সিলেটের প্লেনের তিনটা টিকেট কাটবে!
কাব্যের বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। সে জানে তিনটা টিকেটই কাটতে হবে। লিখন ঠিকই কাল শপিং এ গিয়ে ফিজার জন্য মনের আনন্দে জামা কাপড়, খাবার দাবার, খেলনা জিনিসপত্র সব নিয়ে আসবে! যতবার সে শপিংয়ে যায় টুকটাক একটা কিছু ফিজার জন্য আনবে, প্রতিটি অকেশনে, প্রতিটি ঈদে মেয়েটার জন্য সে মনের আনন্দে বাজার করে। জুতা জামাকাপড়ের সাইজটা একটা মাপে স্থিতি নয়! এখন সে চার বছরের মাপের জুতা জামা কিনে। লিখনকে কখনো এই নিয়ে কষ্ট পেতে দেখিনা!
কাব্য লিখনের মাথাটা তার বুকে টেনে নিয়ে আসে। পিঠে হাত বুলাতে থাকে। কাব্য ও তিন চার মাস পরপর ফিজার জন্য কিছু না কিছু কিনে নিয়ে আসে, শুধু সেইদিন ই লিখন মেয়েটার রুমে গিয়ে হাউমাউ করে কান্না করে! কাব্য লিখনকে কাদঁতে দেয়! মন খুলে কাদঁতে না দিলে লিখন হয়ত কবেই তার জীবন থেকে হারিয়ে যেত! সে তার মেয়ের ভাগ্যর কথা চিন্তা করে! পৃথিবীতে না এসেই যে মেয়েটা মায়ের এত ভালোবাসা পেল, সে যদি পৃথিবীতে আসত, হয়ত তাদের পুরো জীবন অন্যরকম হতে পারত।
শুধু সে রাতে দুজনে খায়না। কাব্য বিছানায় আগেই এসে শুয়ে থাকে। লিখন অনেক রাত করে বিছানায় আসে, বালিশের উপর রাখা কাব্যের হাতে চুপচাপ শুয়ে থাকে। কাব্য দুহাতে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে রেখে লিখনকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়!
সে কখনো লিখনকে সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে যাওয়ার কথা বলতে সাহস পায়নি। শুধুমাত্র মেয়েটার জন্য কেনাকাটা ছাড়া আর কোন অস্বাভাবিক আচরণ তার মধ্যে নেই। জামা কাপড়, খেলনা, খাবার সব বাসায় বেড়াতে আসা শিশুদের দিয়ে দেয়। মাঝে দুজনে মিলে এতিমখানায়ও দিয়ে আসে।
বুধবার ১২টার ফ্লাইটে তারা সিলেট যায়। সেখান থেকে তাহিরপুর যেতে যেতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। লিখনের পুরোনো কলিগ বীথি উপজেলা রেস্ট হাউজে তাদের থাকার ব্যবস্থা করলেও বীথির বাসাতেই তারা উঠে। বীথি তাদের জন্য কত কিছু রান্না করেছে! লিখন বীথির দুই বাচ্চাকে নিয়ে মেতে আছে! অনেক সুন্দর চাদঁ উঠেছে! বীথির উঠানে পাটি বিছিয়ে সবাই মিলে গল্প করছে। চাদেঁর আলো, হাওরের ঠান্ডা বাতাস, মাঝে মাঝে ট্রলার চলে যাওয়ার শব্দ, পানিতে ঢেউয়ের শব্দ- সব মিলিয়ে অসাধারণ একটা পরিবেশ! এখানে মোটামুটি অবস্থাসম্পন্ন সবারই দু একটা নৌকা আছে। বীথিদের উঠানের পাশেই কদম গাছের সাথে দুইটা নৌকা বাধাঁ।
পরের দিন সবাই অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠলো। আসরের নামাজ পড়ে সবাই মিলে নৌকায় ঘুরতে গেল! লিখন ছোট নৌকাটাই পছন্দ করলো। চারিদিকে পানি, অদ্ভুত মিষ্টি বাতাস, বড় বড় ঢেউ। দূরে দূরে সবুজ গাছ দুএকটা দেখা যায়! এই ঢেউয়ের মধ্য থেকেই দুই একটা পাখিরা এসে হাওড় থেকে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে! পরের দুইদিন লিখন কাব্য একাই মাঝিকে নিয়ে ছোট নৌকাটা নিয়ে ঘুরতে যেত। দুইদিনই ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে ঘরে ফিরল।
শনিবারে সকালে তারা তাড়াতাড়ি উঠে! বীথি তাদের জন্য কত রকমের পিঠা বানিয়েছে! ফেরার সময় তাদের সাথেও অনেক পিঠা ধরিয়ে। বাচ্চা দুইটার মন অনেক খারাপ হয়ে আছে। তারা বিদায় নেয়। লিখন আগেই নৌকায় উঠে বসে আছে বাচ্চাদের খুশি করার চেষ্টা করছে।
বীথি কাব্যকে ডেকে একটু দূরে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, লিখন কনসিভ করেছে এ রকম ত কখনো শুনিনি, তাহলে এই মেয়েটার অস্তিত্ত্ব আপনাদের জীবনে আসলো কি করে?
বীথি আপা, বিয়ের আগে আমরা দুজন যখন গল্প করতাম, তখন থেকেই আমাদের ঘর কেমন হবে, কিভাবে আমাদের সময় কাটবে, আমাদের বাচ্চাদের কিভাবে মানুষ করা হবে সব নিয়ে দুজনে গল্প করতাম। স্বপ্ন দেখতাম, আমাদের প্রথম সন্তান হবে মেয়ে। মেয়ের নাম হবে ফিজা। জানেন তো লিখন হল কল্পনাবিলাসী! এইবার যে আমরা নৌকা ভ্রমণ করলাম, তাও আমাদের গল্পে ছিল। লিখনের সব স্বপ্ন পূরণ হয়। ফিজা নামটা শুধু তার স্বপ্নে রয়ে যায়। আমিও ভুলতে পারিনা।