কতটা উন্নাসিক হলে 'অবাঙালি' শব্দ আবিষ্কার করতে পারে - Women Words

কতটা উন্নাসিক হলে ‘অবাঙালি’ শব্দ আবিষ্কার করতে পারে

শবনম সুরিতা ডানা
গতকাল হলভর্তি ইরানী, জার্মান ও রাশিয়ান নারীদের সামনে বাংলা ও উর্দু গান গাইলাম। কেউ আমার ভাষা বোঝেনি, অথচ সবাই শুনেছে। প্রসাদকাকুর তৈরী করা ‘আমি তোমারি নাম গাই’- গানের হিসেবে কী বলতে চায়, তা কেউ বোঝেননি, অথচ গায়নের, সুরের ও সময়ের আবেগ তাঁদের কাছে পৌঁছতে বেগ পায়নি মোটেও। আমার গাওয়া শেষ হয়ে গেলে স্প্যানিশ মেয়েটির ক্ষেত্রেও তাই। কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারছি না, অথচ অসম্ভব ভালো লাগছে শুনতে। ইচ্ছে করছিল যেন আরো আরো শুনি। শুনতেই থাকি।
এসব বলছি কারণ আমি জানি এই অবুঝ ভালোবাসাটুকুর গুরুত্ব। যা জানিনা, যা বুঝিনা, বা যা আমার নিজের নয়, তেমন জিনিসের প্রতিও যে অন্তত ন্যূনতম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা যায়, তা আমরা সবাই ভুলে গিয়েছি। কিছুদিন আগে এক বন্ধুর সাথে এই নিয়ে আলোচনা করছিলাম। একটা ভাষাগোষ্ঠী ঠিক কতটা উন্নাসিক হলে ‘অবাঙালি’ শব্দের আবিষ্কার করতে পারে তা আমাদের কারো মাথায়ই ঢুকছিল না। আমি জানিনা মারাঠী, তামিল, তেলুগু, এমনকি হিন্দির (হিন্দিতে জোর দিলাম, কারণ এই মূহুর্তে ভারতবর্ষে হিন্দি’র জাতীয়তাবাদী আস্ফালন চূড়ান্ত আক্রমণাত্মক হয়ে পড়েছে) শব্দকোষেও এমন কোন অভিধা আছে কি না। অন্তত আমি যে সমস্ত ভাষাগুলি কমবেশি জানি, ইংরেজি, হিন্দি বা সিলেটী, তার কোনটাতেই এমন কোন কিছু আমার চোখে পড়েনি। একবার ভেবে দেখুন তো, একটা গোটা জাতি, যে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ ভাষাগোষ্ঠী, যার ইতিহাস কিনা একাধিক স্বাধিকার আন্দোলনের সাক্ষী, সেই ভাষার শব্দভাণ্ডারে এমন একটি শব্দ বিরাজমান, যা এই উপমহাদেশের ভাষিক বৈচিত্র্যকে মূলে আঘাত করে, অপমান করে। শব্দানুসারে, এক বাঙালির চোখে একজন মানুষের অস্তিত্বের গুরুত্ব মাপা হবে শুধুমাত্র সে বাঙালি কি না, এই মাপে। উল্টোদিকে থাকা ব্যক্তিটির নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি সেখানে একেবারেই গুরুত্বহীন!
ফেসবুকে দেখছি আমার অনেক বন্ধুরা একটি বিশেষ খবরের কাগজে ভুল বাংলা ছাপার প্রতিবাদ করছেন। ভালো কথা। এটাও দেখলাম অনেকে ধুতি-লুঙ্গী পরে বিভিন্ন শপিং মলে ঢুকে বাঙালিত্বের আত্মমর্যাদা রক্ষার্থে নামবেন বলে তৈরী হচ্ছেন। এটাও ভালো কথা। কিন্ত একটা কথা কেউ কি কখনো ভেবেছেন, যে জাতি হিসেবে আমরা আসলে ঠিক কতটা উন্নাসিক, অপরপন্থী? যদি না ভেবে থাকেন তাহলে পাশের রাষ্ট্র বাংলাদেশের দিকে তাকান। বাংলাদেশ থেকে যা আমাদের শিখতে হবে তা অবশ্যই তাঁদের ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালিত্ব, যে কারণে আজও একুশের ঢাকা অনুপ্রাণিত করে পৃথিবীর সকল বাঙালিকে, সকল ভাষার সমান অধিকারে বিশ্বাসী সকল মানুষকে। কিন্ত এর পাশে এটাও মনে রাখতে হবে, যে বাংলা ভাষায় রাষ্ট্রচালনার, বাঁচার অধিকারের জন্য এই রাষ্ট্রের জন্ম, সেই রাষ্ট্রের বাঙালিত্বের সংজ্ঞায় কোন স্থান নেই ‘বিহারী মুসলমানদের’, কোন স্থান নেই পাহাড়নিবাসী চাকমা ও অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর। বাঙালি চেতনা ও বাংলাদেশী চেতনার ঠিক কোথায় পারস্পরিক আদানপ্রদান হবার কথা ছিল, তা আজও কেউ ঠাহর করে উঠতে পারেনি পুরোপুরি। ফলস্বরূপঃ একটি শিক্ষাব্যবস্থা যা আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে রীতিমত ঠুনকো, একটি জাতি যা বাঙালিত্বের উদযাপনে অতুলনীয়, অথচ পাশের ভাষাগোষ্ঠীকে রাখে আক্রমণে জর্জরিত করে।
কিন্ত আমি বিশ্বাস করি যে বাঙালি এখনও ক্ষমতা রাখে নিজেকে শোধরাবার। উনিশে মে’র কথা মনে করিয়ে দিই আরেকবার। যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল বাংলা ভাষার জন্য, গত কয়েক বছরের উনিশ উদযাপনের দিকে তাকালে বুঝতে পারবেন কীভাবে একটি ভাষাগোষ্ঠীর আন্দোলন বহুত্বের উদযাপনে পরিণত হয়। অনেকেই জানেন না, উনিশের উত্তরাধিকার কেবলমাত্র ১৯৭২, ১৯৮৬-র বাংলাভাষী শহীদদের মধ্যেই নেই। আছে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী শহীদ সুদেষ্ণা সিনহার মধ্যেও। এই বাঙালিত্ব ‘অবাঙালি’ সংজ্ঞাকে অস্বীকার করে। এই বাঙালিত্ব ধুতি পরতে জানে ঠিকই, কিন্ত পাশের বাড়ির ফানেক-ইনাফি থেকে দাওরা-সুরুওয়াল খায় না মাথায় দেয় তা জানুক না জানুক, ‘অবাঙালি’ আখ্যা দেয়না।
ইউরোপে বেড়াতে বেড়াতে শিখি প্রধানত একভাষী দেশগুলির যুবপ্রজন্মের মধ্যে বেকার সমস্যা এবং জাতি-বিদ্বেষের মূল কারণ এই একভাষিক চরিত্র। ভারতবর্ষের সমস্যাগুলির সাথে যদিও এর কোন তুলনা করা চলেনা, তবুও ঠাণ্ডা মাথায় ভাবলে মাঝে মাঝে অন্যরকম মনে হয়।
ঠিক-ভুল জানিনা, তবে আমিও গর্ব করি আমার বাংলা ভাষার জন্য, আমার ইতিহাসের জ্বলজ্বলে উত্তরাধিকারের জন্য। কিন্ত আমার বড্ড লজ্জা করে আমার বন্ধু সোনাকে অবাঙালি বলতে। সোনা মালায়ালী, মেরিঅ্যান কোঙ্কনী, পূজা খাসি-মারাঠী। ওরা কেউ অবাঙালি নয়।