আমাদের নক্ষত্ররা - Women Words

আমাদের নক্ষত্ররা

Romena Laisনক্ষত্র তাঁরাই, যারা আপন আলোয় উদ্ভাসিত। তাঁরা শুধু নিজে আলোকিত হন-তা নয়, আলো বিলিয়েও যান। আমার জন্ম শহর সুনামগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ ‘সতীশ চন্দ্র উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়’। গত ৭৫ বছরে অনেক শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছেন এখান থেকে। মেয়েদের বেলায় পড়াশুনা শেষ করার আগেই অনেকের বিয়ে হয়ে যায়। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে কেউ কেউ নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেন। আজ আমি সেরকমই বিখ্যাত একজনের কথা লিখছি। তাঁর নাম ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ।

সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চল সুখাইরের জমিদার পরিবারে ১৯৪৫ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সুধাংসু শেখর চৌধুরী ও মা নীলিমা চৌধুরীর প্রথম সন্তান তিনি। সুনামগঞ্জ শহরের হাসননগরে অবস্থিত স্টেডিয়ামের দক্ষিণ দিকে তাঁর বাবার বাড়ি। ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ সতীশ চন্দ্র উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯৫৭ সালে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৫৯ সালে সুনামগঞ্জ কলেজ থেকে পাশ করেন উচ্চ মাধ্যমিক। বিএ’তে ভর্তির কিছুদিনের মধ্যে শৈলেন্দ্র শেখর দাশ পুরকায়স্থর সাথে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। স্বামীর কর্মস্থল রাজশাহী হওয়ায় সেখানে বাংলা বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হন। একে একে চার সন্তান আসে তাঁর কোল জুড়ে। ফলে পড়ালেখায় বাঁধা পড়ে। ১৯৬৮ সালে তিনি স্বামীর কর্মস্থল পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান।১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তারা সপরিবারে গৃহবন্দি হয়ে পড়েন। বহুকষ্টে কোয়েটা ,কান্দাহার ,কাবুল হয়ে একমাস পরে ঢাকা এসে পৌঁছান তারা। তাঁর ‘মেঘ জ্যোৎস্নায় মুক্তিযুদ্ধ’ পড়লে জানা যাবে সেই রোমহর্ষক দিন-রাতের গল্প।

১৯৭৩ সালে ফিরে আসেন দেশে। মানুষের ইচ্ছাশক্তি অনেক বড় চালিকা শক্তি। একটু গুছিয়ে নিয়ে ১৯৭৬ এ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মাস্টার্সে নাইট ক্লাসে ভর্তি হন। সমাপনী পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। সে বছর এ বিষয়ে আর কেউ প্রথম শ্রেণী পায়নি। তাঁর সাথে কথা বলে জেনেছি, উনার মৌখিক পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার প্রফেসর আকরাম স্যার জানতে চেয়েছিলেন, কেন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে প্রথম শ্রেণী পেতে পারতেন।

jorna-desh-purokayesta-02-women-wordsসংসার -সন্তান সামলে তিনি পড়াশুনা ও লেখালেখি চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন। কারণ তার স্বামী তাঁকে উৎসাহ যুগিয়েছেন সবসময়। সারাজীবন সাহিত্য ,সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ। বাংলাভাষাকে এই উপমহাদেশে ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন। ১৯৭০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রথম স্বরচিত বাংলা কবিতা পড়ে সম্মাননা লাভ করেন তিনি। তাঁর রচিত শিশু সাহিত্য বই বের হয়েছে মোট ৩৬ টি। উপন্যাস লিখেছেন ১০ টি। ছোট গল্প লিখেছেন ১৫ টি। তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন নানা সংগঠন থেকে।

প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য পদকগুলো হচ্ছে ১. সাজেদুন্নেসা খাতুন চৌধুরী সাহিত্য পদক ১৪০১ বাংলা। ২. বাংলাদেশ জাতীয় সাহিত্য পরিষদ ও সমাজ সেবা পদক ১৯৯৪। ৩. বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক ১৯৯৬। ৪.  কমর মুশতারী স্মৃতি পুরস্কার ১৯৯৮। ৫. সিলেট লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক ২০০০। ৬. আগুনের ফুলকী শিশু উন্নয়ন পুরস্কার (শিশু সাহিত্য )১৯৯৯। ৭. রিআ্যাফ সাহিত্য পুরস্কার ২০০২। ৮. আশরাফ সিদ্দিকী ফাউন্ডেশন সাহিত্য পদক ২০০২। ৯. ঢাকা সাহিত্য সংস্কৃতি গোষ্ঠি গোল্ড মেডেল পদক ২০০৩। ১০. কবি সংসদ বাংলাদেশ পদক ২০০৮ ১১. আলোয় ভূবনভরা বিজয় দিবস সম্মাননা পুরস্কার ২০০৪। ১২. এম নূরুল কাদির শিশু সাহিত্য পুরস্কার ২০০৬ ১৩. রাগীব রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার ২০০৬। ১৪. অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার ১৩১৫ বাং। ১৫. নন্দিনী সাহিত্য পুরস্কার ২০০৯। ১৬. অগ্রনী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার। ১৭. লেডিস ক্লাবের ৬১তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে সম্মাননা ক্রেস্ট লাভ করেন ৪ জুন ২০১৬ তে।

এছাড়াও তিনি বাংলা একাডেমী, লেখিকা সংঘ বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ লেখক সংঘের আজীবন সদস্য । রেডিও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত গীতিকারও তিনি। বর্ণাঢ্য আলোকময় জীবন তাঁর। তিনি ভ্রমণ করেছেন ভারত ও জার্মানী।

আজকালকার বাচ্চারা আকাশ দেখতে পায় না। অথচ মানুষের মনের জগতকে সমৃদ্ধ করে প্রকৃতি। সুনামগঞ্জের বাড়িতে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ আর রাস্তার দুপাশে কচুরীপানার বেগুনী ফুল ,সুখাইরের হাওর-বাওর দেখে দেখে বড় হয়েছেন বলে এখন নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ।