রাধিকা - Women Words

রাধিকা

রোমেনা লেইস

মোবাইলে প্রিং করে শব্দ হলো।মুমু মোবাইল টা টেনে নিলো।ঘুম ঘুম ভাব এসেছিলো মাত্র। ‘রাধিকা’ ! কী? স্ক্রীনে এই একটা শব্দ দেখে ভাবে এর মানে কী? কে সেন্ড করলো? উঠে বসল। চেক করতে গিয়ে আরও চমকে গেল। এটা ওর ম্যানেজার রায়হান সাহেবের নম্বর । মুমু আনসারী। সোনালী ইনস্যুরেন্স এ কাজ করে আজ দশ বছর। প্রথম পোস্টিং ছিলো চট্টগ্রাম। ওখানে ওর বড় ছেলের পাঁচমাস বয়স যখন তখনই জয়েন করে। ওর হাজবেন্ড তখন চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের লেকচারার।একটা ট্রেনিং এ ঢাকায় গিয়েছিলো মুমু চাকরীর দুইবছরের মাথায়। তখনই প্রথম দেখা হয় রায়হানের সাথে। প্রথম দেখার পর কথা হতেই দেখা গেলো রায়হান আর ওর বর মিনহায একই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হলে থাকতো। খুব বন্ধু না হলেও পরস্পর পরিচিত। –মিনহায আর আমি এক হলেই থাকতাম। -তাই? –আপনি কী মন্নুজান হলে ছিলেন ? -না আমি রোকেয়া হল। — ক্যাম্পাসে আপনাকে কখনো দেখিনি । -আমি ক্লাস করে রিকশা নিয়ে হলে চলে যেতাম। ট্রেনিং ছিলো সাতদিনের । সেই সাতদিনের ব্রেকটাইম গুলোতে কথা হতো ।এভাবেই যোগাযোগ ।তারপর আবার চিটাগাং চলে আসল। তিনবছর পর মুমুর বর বদলি হলো দিনাজপুর সরকারি কলেজে। তখন মুমুও বদলী নিয়ে দিনাজপুর জোনাল অফিসে চলে আসে। তখন এরিয়া ম্যানেজার হিসেবে পায় রায়হানকে। আজ চারবছর একসাথে কাজ করছে কখনো এতোটুকু অন্যরকম মনে হয়নি মুমুর। সবসময় ফর্মাল। পেশার প্রয়োজনে যতটুকু কথা বলা দরকার ঠিক ততটুকুই কথা বলে। কখনো ব্যবহারে কোনরকম দুর্বলতা প্রকাশিত হয়নি। তাই মোবাইলের স্ক্রিনে ‘রাধিকা লেখার দিকে তাকিয়ে বুকের ভিতর তির তির কম্পণ অনুভব করছে। দশদিনের ছুটিতে কক্সবাজার গিয়েছিলো মুমু ওর ছোটবোন আর বাচ্চাদেরসহ। কক্সবাজার থেকে চিটাগাং এসে ট্রেন মিস করে ফেললো। মহানগর প্রভাতী, ওরা প্লাটফরমে ঢোকার আগেই ট্রেন ছেড়ে চলে গেলো। ক্যালকুলেশন গন্ডগোল হয়ে গেলো মুমুর। ভেবেছিলো ঢাকা পৌঁছে ছোটবোনের বাসায় একটু রেস্ট নিয়ে রাতেই রওয়ানা দিয়ে পরদিন ভোরে দিনাজপুর পৌঁছে সকালে কাজ যোগ দিবে। যাহোক বিকেলে তূর্ণা নীশিথাতে রওয়ানা দিলো। ষ্টেশনের দোতলায় ওয়েটিং রুমগুলো বেশ চমৎকার। সেখানে ছয় সাতঘন্টা ওয়েট করে বিকেলবেলা ট্রেনে রওনা হলো।ওরা দুইবোন গল্প করে হাসাহাসি করছিলো খুব। তখনি সহযাত্রীদের এক জন বললো -আপা একটা দুঃসংবাদ আছে। এস এম কিবরিয়া, সাবেক অর্থমন্ত্রী উনার জনসভায় বোমা হামলা হয়েছে। উনি নিহত হয়েছেন। — কীভাবে জানলেন? -গ্রামীণ ফোনের ম্যাসেজ অপশনে এইমাত্র আসলো আপা। এই নিউজ শুনে আনন্দ সব শেষ। ট্রেন চলছে ঝমঝম করে। কিন্তু ভোরবেলায় ঢাকা পৌঁছে যদি হরতাল দিয়ে দেয় তাহলে কী হবে তা ভেবে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। ঢাকা পৌঁছাতে ভোর হয়ে যাবে। মিনহায কক্সবাজার যাওয়ার আগের রাতে হঠাৎ করে সারপ্রাইজ গিফট নিয়ে হাজির হয়েছিলো । স্যামসাং এর মোবাইল ফোন। কোরিয়ার তৈরি খুব সুন্দর সেটটি। একটেল এর সিম সেই ফোনে। বহুদিন থেকেই বাচ্চাদের নিয়ে কক্সবাজার যাবার প্ল্যান। মিনহাযের আর সময়ই হয়ে ওঠে না।পরীক্ষা কমিটির ইনচার্জ সে। রিমুনারেশন পেয়েই গিয়ে ফোন কিনে ফেলে আর প্ল্যান করে মুমু আর ওর যে বোন ঢাকায় থাকে সেতু , সেই বোন মিলে তাদের তিনবাচ্চা নিয়ে যাবে কক্সবাজার ।শৈবালে রুম কনফার্ম করে ফেলে। ট্রেনেই যায় ঢাকা থেকে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যায় বাসে। সেল ফোনে মিনহায ছেলে মেয়ের খোঁজ নেয়। কখন কোথায় কী অবস্থায় আছে, কোন অসুবিধা হচ্ছে কি না। মুমু রায়হান কে ফোন করেছিলো পরিস্থিতি জানিয়ে । –আগামীকাল হরতাল দিয়েছে স্যার,এখন আমি তো ঢাকায় আটকে গেলাম। আজই আমার ছুটি শেষ। -অসুবিধা নাই। তবে পরশুদিন পৌঁছেই অফিসে আসবেন। — ঠিক আছে। রায়হানের সাথে কথা বলে বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে বাচ্চাদের নীচে টিভি দেখতে দিয়ে ও শুয়েছিলো। আর তখনি ম্যাসেজ এর সাউন্ড হলো। ম্যাসেজ টাইপিং তখনো ভাল পারে না মুমু। ভয়ে ভয়ে কল ব্যাক করে রায়হানকে -স্যার ‘রাধিকা ‘মানে বুঝলাম না। কী হয়েছে? — ওহ এটা কলকাতার একজন ডাক্তারের নাম।আমি আমার এক আত্মীয়কে টেক্সট করতে গিয়ে ভুলে আপনার কাছে চলে গেছে। নেভার মাইন্ড। -ওহ। আচ্ছা। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো মুমুর । দিনাজপুর পৌঁছালো বিকেলবেলা ।বাস টার্মিনালে মিনহায এসেছে।ও মিনহাযের সাথে বাচ্চাদের আর লাগেজপত্র সব পাঠিয়ে দিলো। তারপর গেলো অফিসে। ক্লান্ত, বিধস্ত । রায়হান এর চেম্বারে গেলো। –এখনি আসলেন? -জী স্যার –কোনো অসুবিধা হয়নি? -না হানিফ পরিবহনের গাড়িটা নতুন আর ড্রাইভার ও ভালো ছিলো । বেল চেপে পিয়ন ডেকে কোল্ড ড্রিংকস আর কেক দিতে বললো রায়হান । -রিলাক্স। কেমন বেড়ালেন কক্সবাজার ? –বেড়ালাম তো ভালই স্যার ।এই শেষের টেনশনটুকু ভাল লাগলো না। -ডোন্ট ওরী। খাতায় সাইন করেন, টাইম দিবেন না। — জী স্যার। থ্যাংক ইউ সো মাচ। কেকের পীসে একটা কামড় দিতে দিতে ভালো করে তাকায় মুমু রায়হানের দিকে। নাহ ওর দিকে তাকাচ্ছেও না। আপনমনে ফাইলপত্র সিগনেচার করছে। -আপনি থাকেন কোথায় যেন? — কাছেই স্যার কলেজ কোয়ার্টারে । -আমার হাতের কাজ শেষ প্রায়। আপনি আস্তে আস্তে খাওয়া শেষ করেন।আমি নামিয়ে দিয়ে যাব। — না না স্যার , অনেক ধন্যবাদ আমি রিকশায় চলে যেতে পারবো। -বসেন ।এমন ভাবে বললো যে মুমু আর কিছু বলতেও পারলো না।গাড়িতে নামিয়ে দিয়ে গেলেও কোনো রকম বাড়াবাড়ি কিছুই করলো না। পরের মাসে মিনহায ঢাকায় শিক্ষা অধিদপ্তরে সহকারী পরিচালক হিসেবে ট্রান্সফার হলো। তার একমাস পর মুমুও চলে গেল ঢাকায়। বাসা শ্যাওড়াপাড়ায় আর অফিস আগারগাঁও । অফিসে যেতে আসতে আর কাজ করতে করতে মুমুর দিনকাল কাটে ভীষণ ব্যস্ততায়। এরমধ্যে নিউইয়ারে অনেক গুলো উইশের ভীড়ে রায়হানের উইশ ছিলো… Happy New Year. Bright future are coming soon. Raihan. পাল্টা উইশ জানিয়ে দিলো মুমু। এরমধ্যে এক বিকেলে অফিস থেকে বের হবে তখন হঠাৎই সেলফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠলো -আপনাকে অনেক দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি নীচে অফিসের অপজিটে অপেক্ষা করছি। রায়হান । এসি রুমের ভেতর মুমু ঘামতে শুরু করলো। গলা শুকিয়ে গেল। ঠান্ডা পানি এক বোতল খেয়ে ফেললো। আয়নায় নিজেকে দেখলো। ত্রিশ পার হয়েছে বছর তিনেক আগে। এই বয়সে তার তিন ছেলে মেয়ে ।মিনহায প্রায় ই বলে -তোমাকে দেখলে কিন্তু এখনো পঁচিশ ই মনে হয়। — আচ্ছা যাও। খুব বাড়িয়ে বলো। বলো আঠারো । মিনহায ওর কোমর পেঁচিয়ে রাখে ডানহাতে। মুখে বলে -দেখ নো চর্বি। কী মসৃণ । কিন্তু রায়হানের কী হলো? লিফটে নীচে নেমে বাইরে হাতের ডানে এসে রাস্তা পার হলো। তখনই দেখল রিকশায় রায়হান বসা। ওকে রিকশায় উঠতে আপত্তি আছে কীনা জানতে চাইলো। ও উঠে বসলো। দশবছরের চেনাজানা হলেও এতো কাছে কখনো আসেনি। রিকশায় বসতে গিয়ে শরীরে ঠেকে যায় শরীর। -কী ব্যাপার বলুনতো? — আপনাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছিলো। কেমন আছেন? -ভালো। কিন্তু কেন? — তাতো জানিনা। আগে প্রতিদিন দেখতাম ছুটির দিনগুলোতে শপিংমল বা রেস্টুরেন্টে দেখতাম। চোখ দেখতে অভ্যস্ত ছিলো। চোখে তৃষ্ণা,বুকে তৃষ্ণা। কেমন যেন এক শূন্যতা খাঁ খাঁ করে। একে কী বলে আপনি জানেন? — না ।আমি জানি না। আবার বুক ধুপধুপ। গলা শুকিয়ে যায়। -হাতটা ধরি? — না না । ঝির ঝির করে বৃষ্টি পরছে । হুড তুলে দিতে হলো। – কাছে আসি ? আরও একটু? বুকের কাছে জড়িয়ে রাখে মুমুকে । আর রিকশার প্লাস্টিকের আড়ালে তৃষ্ণা মিটানোর জন্য ঝুঁকে পড়ে । বুকের ভেতর হাতুরী পেটানোর মত শব্দ।আর অবিরাম তপ্ত ঠোঁটের আকন্ঠ চুম্বনে সব এলোমেলো হয়ে যায় মুমুর। -ঢাকায় কাজ ছিল। তাই আজ মনেহলো দেখেই যাই। রিকশা চলছে আগারগাঁও এর দিকে একটা চায়নীজ রেস্টুরেন্টে নামলো ওরা। এই প্রথম মুখোমুখি বসলো। –রাধিকা এর মানে কী বলবেন স্যার? রায়হান মুখ টিপে টিপে হাসে।বলে -রাধিকা কে ছিলো ? আপনি কিছু বোঝেন না কেন? আপনার ট্রেনিং পিরিয়ডের সময় থেকে আমার হৃদয় আপনার কাছে বাধা পড়েছে ।আপনাকে দেখলেই আমি অস্থির হয়ে যাই।আর আপনি যেন কিছুই বোঝেন না। মুমু বলে -সত্যি আমি কোন দিন বুঝিনি এমন কিছু।উদাস হয়ে যায় মুমু। পেছনের দিনে ফিরে যায়। কতো কী ভাবে। রেস্টুরেন্টে খাবার অর্ডার দিয়ে ওর হাত হাতে টেনে নেয় রায়হান। হাতের পিঠে ঠোঁট ছোঁয়ায় । কেঁপে কেঁপে ওঠে মুমু।