মিলনমেলায় আসা যাওয়ার পথের ধারে (৩) - Women Words

মিলনমেলায় আসা যাওয়ার পথের ধারে (৩)

romena-lais-women-wordsরাত আর যেন কাটে না। কখন স্কুলে যাব। বন্ধুদের হাতে হাত রেখে বসবো। ২৪ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে আটটায় স্কুলে গিয়েই ফটোসেশন শুরু হলো। অনুষ্ঠান তখনো শুরু হয়নি। স্মৃতিচারণ পর্বে আমাদের বন্ধু এডভোকেট মাহফুজা বেগম সাঈদা স্মৃতিচারণ করছিলো। তারপর মঞ্চে আমন্ত্রণ জানানো হয় মাউশির প্রাক্তন মহাপরিচালক প্রফেসর দিলারা হাফিজকে। দিলারা আপা সবাইকে নিয়ে গেলেন সেই ষাটের দশকে । উনার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে স্মৃতিচারণ পর্ব শেষ হলো।

এরপর ছাত্রীদের পারফরমেন্স পর্ব শুরু হলো। প্রথমেই মঞ্চে উঠলো ৮২ ব্যাচ। “আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী, সাথী মোদের ফুলপরী” নিয়ে। ঝলমলে রোদওঠা সৃবর্ণ সকাল। মেয়েরা সব ব্যাচে ব্যাচে নানা রঙে সাজিয়েছে নিজেদের। নীল ,সবুজ গোলাপী,কমলা ,লাল ,সোনালী বেগুনী। মঞ্চ আলো করছে একের পর এক ব্যাচ। সামনে বয়স অতিক্রম করে একসাথে নেচে চলছে সকলে।

আমাদের বন্ধু ডাক্তার লুৎফুন্নাহার জেসমিন বিদায় নিয়ে চলে গেছে আগের রাতেই। তাই মন আমাদের কিছুটা ভারাক্রান্ত। আনন্দ উল্লাসের ফাঁকে ফাঁকে বারবার মনে হচ্ছে আজই শেষ দিন। মিলনমেলা ভাঙলে আমরা আবার দলছুট হয়ে হারিয়ে ফেলবো একে অন্যকে। আমরা স্কুলের বেঞ্চে যে ভাবে বসতাম সেভাবে বসেছিলাম একটা সোফায় গায়ে গা লাগিয়ে, হাতে রেখে হাত। দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত একটা মূহুর্তও হারাতে চাইনি, তাই কেউ একবারো সীট ছেড়ে উঠে যাইনি। নতুন প্রজন্মের মেয়েরা দারুণ চৌকষ। আমার ছাত্রীরা,তাদের পরের ব্যাচ ওইটুকু সময়ে দারুণ সব উপস্থাপনা নিয়ে আসলো।২০০৩ -০৪ এর চমৎকার নৃত্যশৈলী দেখলাম। ২০০৫ নিয়ে এলো ক্যাটওয়াক। তারা ফ্যাশন শো করলো গানের তালে তালে। আর নৃত্যনাট্য নিয়ে আমাদের একদম হতবাক করে দিলো ২০১০-১৬। সময় স্বল্পতার কারণে তাদের বারবার সংক্ষিপ্ত করতে বলা হচ্ছিলো, কিন্তু তারা সংক্ষিপ্ত সময়ে এবরশন, শিশু এবিউজ সব তুলে ধরলো কোরিওগ্রাফির মাধ্যমে। ম্যাজিক দেখালো একব্যাচ।

ইউ কে থেকে আগত নার্গিস এর উপস্থাপনায় এরপর শুরু হলো প্রবাসীদের পর্ব। প্রবাসী দেশের মধ্যে ইউএসএ , অস্ট্রেলিয়া,ইউকে ,কানাডা প্রধান। তিরিশ মিনিট সময়কে চারভাগ করে আমাদের সাত আট মিনিট করে পরেছে। ইউ এসএ থেকে আমরা মাত্র দুজন। নিউইয়র্ক থেকে আমি আর পেনসিলভেনিয়া থেকে মৌসুম। আমরা ইউএসএ থেকে অনলাইনে যে কুইজ চালিয়েছিলাম সেটির পুরস্কার দিয়েই কানাডা,অস্ট্রেলিয়া আর ইউকে বাসীদের সুযোগ দিলাম। অষ্ট্রেলিয়া থেকে আগত বোন সীমা তার কবিতা পাঠ করলো। কানাডার অটোয়া থেকে আসা নায়না তাদের বৃত্তি প্রদানের বিষয়টি সংক্ষেপে জানালো। ইউকে থেকে আগত খাইরুন সিদ্দিকী, সে আলাবুন্নেসা খাতুন ডালিম আপাকে নকল করে বলে -এই মেয়েরা চুপ। বলতেই সবাই থমকে গিয়েছিলো মুহূর্তের জন্য। আমাদের শরীরচর্চা শিক্ষক ডালিম আপাকে আমরা ভুলিনি। যদিও আমাদের ইচ্ছে ছিলো খাইরুনের পরিচালনায় আমরা সবাই শরীরচর্চা করবো। ভুল করলে ডালিম আপার অনুকরণে খায়রুন আমাদের বকুনী দেবে। সময় স্বল্পতার কারণে তা আর হয়নি। প্রবাসীদের সময় কেড়ে নিতে কোন এক ব্যাচ এসময় পুনরায় মঞ্চে আরোহন করে। যা ছিলো হাস্যকর ও দৃষ্টিকটু। এর পরপরই শুরু হয় দম্পতি, পিতা -কন্যা, মা -কন্যা , শিল্পীদের দ্বৈত পরিবেশনা । ‘আয় খুকু আয়’বাবা আর মেয়ের গানটি ভাল লাগে। দেবদাস -তুলিকার গানটি ভীষণ আনন্দ দেয়। ‘এই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে’ গানটি মা আর মেয়ে রুনা আর রূপকথা গেয়ে মুখর করে তোলে। পুরা অনুষ্ঠানে সবাই আঞ্চলিক গান,বাংলা গানই গেয়েছিলো। একজন অতিথি শিল্পীর উর্দু গান গাওয়া আমাদের পছন্দ হয়নি। শিল্পকলার শিল্পীরা গায় “ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ুরপঙ্খি নাও।” শেষদিনের প্রথম থিম সং তৃষ্ণা শুক্লার (১৯৭৩ ব্যাচ)রচিত। সুর করেছে দেবদাস চৌধুরী রঞ্জন। গানটি গাইলো বিদ্যালয়ের নবীন ছাত্রীরা। আর দ্বিতীয়টি আমার (১৯৭৯ ব্যাচ) লেখা। “মন ছুটে যায় স্কুলে আহা…।” এটিরও সুর করেছে দেবদাস চৌধুরী রঞ্জন।

সর্বশেষ আকর্ষণ অতিথি শিল্পী কুমার বিশ্বজিত। তার ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’ দিয়ে শুরু করেন। সকল জনপ্রিয় গান গেয়ে তিনি দর্শকদের  জমিয়ে তোলেন। ‘অন্তর জ্বলেরে জ্বলে’ আমার এখনো কানে বাজছে। আর এরই ভেতর দিয়ে শেষ হয়ে গেলো পঁচাত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে দুইদিনের মিলনমেলা।

এতবড় একটা আয়োজন করা খুব সহজ নয়। আয়োজকরা অবশ্যই ধন্যবাদ পাবেন। এই আয়োজন আমাদের আরও একবার স্কুলের সেই দিনগুলোতে ফিরে যাবার সুযোগ করে দিয়েছিলো। তবে আরেকটু আন্তরিকতার প্রয়োজন ছিলো খাদ্য কমিটির।খাবার ছিলো অত্যন্ত নিম্ন মানের। যেটা আরেকটু উন্নত করা উচিত ছিলো। আর শিক্ষকদের মর্যাদা সবার উপরে। প্রবীন, প্রাক্তন শিক্ষকদের মধ্যে যারা উপস্থিত ছিলেন, আয়োজকদের উচিত ছিলো তাঁদের অন্তত সম্মাননা দেয়া ।মঞ্চে বসিয়ে একটা ফুলের তোড়া বা একটি গোলাপ দিয়ে ও সেটা করা যেতো। আমি জানি না এটা অনিচ্ছাকৃত ভুল, নাকি ইচ্ছাকৃত। আমরা মানুষ ।মানুষের ভুল ত্রুটি থাকবে। ভুলগুলো বাদ দিয়ে এই আয়োজনকে একটি ইতিহাস হিসেবে মেনে নিই। এই মিলনমেলাকে সার্থক করে তুলতে শুধুমাত্র স্কুলকে ভালবেসে নিরলসভাবে শ্রম দিয়ে গেছেন যারা, শ্রদ্ধার সাথে তাদের কৃতজ্ঞতা জানাই। ‘ভরা থাক স্মৃতি সুধায় ভরা পাত্রখানি।’