জর্জ ওয়াশিংটনের আঙ্গিনায় - Women Words

জর্জ ওয়াশিংটনের আঙ্গিনায়

Romena Laisযুক্তরাষ্ট্রে প্রথম এসেছিলাম তখনই পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম দেশটির অর্ধশত স্টেট ঘুরে দেখার। যখনই সুযোগ পাই সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেমে পড়ি। এবারের ঈদের ছুটিতেও তার ব্যতিক্রম হলো না। ভার্জিনিয়া, ম্যারিল্যান্ড, ওয়াশিংটন ডিসি ঘুরা হয়ে গেল।
শেরেবাংলা বয়েজ স্কুলে যখন শিক্ষকতা করতাম সেই সময়ের সহকর্মী সোনালী থাকে ভার্জিনিয়ায়। একই সময়ে আমরা যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলাম। মাঝে একবার সে নিউইয়র্কে বেড়াতে এলো। আমার বাসায় উঠেছিল সেবার। তখনই ভার্জিনিয়ায় ঘুরতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিল। আমাদের আর যাওয়া হয়নি।
ঈদের নামাজ শেষে খাওয়া-দাওয়া সেরে রোদ ঝলমলে সকালে আমরা সপরিবারে রওয়ানা হলাম ভার্জিনিয়া। ভ্যারাজোনা ব্রীজ দিয়ে নিউইয়র্ক ছেড়ে স্ট্যাটেন আইল্যান্ড হয়ে যখন যাচ্ছিল তখন বেশ লাগছিল। নিউইয়র্কের ব্যস্ত রাস্তা আর কোলাহল পেছনে ফেলে ততক্ষণে আমরা চলে এসেছি খোলামেলা এপলেশিয়ান মাউন্টেইন রেঞ্জে। আঁকাবাকা পথ পেরিয়ে বেলা তিনটার দিকে আমরা পৌঁছে গেলাম ভার্জিনিয়া। এ রাজ্যে এই প্রথম এলাম। সুন্দর ছিমছাম টাউন হাউস সোনালীদের। ব্লকগুলো অনেকটা বাংলাদেশের সেনানিবাসের বাড়িগুলোর মত। সোনালীর স্বামী স্বপনদা হাসিখুশি মানুষ। ছেলে শৌমিক লাজুক হলেও মেয়ে স্বাগতা বেশ চটপটে আর মিশুক। দেশে থাকতে ঢাকার হলিক্রসে পড়তো। এখন ফেডারেল গভর্ণরের এগ্রিকালচারাল ডিপার্টমেন্টে ইন্টার্নশীপ করছে। যদিও গিয়েই তাদের দেখা পাওয়া গেল না, দুজনেই তখন কাজে ছিলো। আমাদের আপ্যায়ন করার জন্য সোনালী প্রচুর খাবার-দাবারের আয়োজন করেছে। সেগুলো গলদকরণ করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।
ভার্জিনিয়া দর্শনের শুরুতেই আমরা গেলাম আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের বাড়ি দেখতে। প্ল্যান্টেশন নিয়ে তাঁর দাদা কাজ শুরু করেছিলেন। সেই ধারা অব্যাহত রেখে পোট ম্যাকৌ নদীর তীরে প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন আর তাঁর স্ত্রী মার্থা চমৎকার এই বৃক্ষগ্রাম গড়ে তোলেন। প্রাসাদটি প্যালাডিয়ান স্টাইলে কাঠের তৈরি। হ্যাম্প চাষের পাশাপাশি তামাক আর গম চাষও হতো।
চমৎকার গ্রাম সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো। হ্যাম্প অনেকটা বাংলাদেশের পাটের মত। বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে। হ্যাম্প থেকে দড়ি তৈরি হতো। এর আঁশ থেকে কাপড়ও তৈরি হতো। এর বীজ থেকে ঔষধ যেমন তৈরি হতো তেমন নেশা জাতীয় দ্রব্যও তৈরি হত। শনের মত ছাউনিতে এর পাতা ব্যবহৃত হতো। মাছ ধরার জাল তৈরিতে এর আঁশের সুতো ব্যবহার হতো। এর তেল রঙ করার কাজে বার্নিশেও ব্যবহার হতো। তাঁর পাঁচটি ফার্মের বিশাল এলাকা জুড়েই চাষ হতো হ্যাম্প। ব্যস্ত নগর জীবন ছেড়ে যেন ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়। মন জুড়িয়ে গেল।
ভার্জিনিয়া বীচের কাছাকাছি ম্যারিওটের স্যুট বুকিং দেয়া ছিলো। রুমে ঢুকে কিছুটা রিলাক্স হয়ে আমরা রাতের খাবার খেয়ে নিলাম একটা রেস্টুরেন্ট এ। তারপর গেলাম ফিশিং পীয়ারে।
নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে।
সমুদ্রের তুমুল গর্জন শোনা যাচ্ছে। হঠাৎই ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকানো শুরু হলো। কালো মেঘ ঢেকে দিলো চাঁদ। আমরা তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরে গেলাম।

ঘুম ভাঙলো অচেনা পাখির ডাকে। চটপট রেডি হয়ে নীচে ডাইনিং হলে গেলাম। ব্রেকফাস্ট এর বিশাল আয়োজন থেকে পছন্দমতো দু’তিন পদ তুলে নিয়ে বসলাম। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বাইরে বের হলাম ছবি তুলতে। চেক আউট করে আমরা ছুটলাম সাগরের টানে। বিশালতা নিয়ে আটলান্টিক ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে ভার্জিনিয়ার মাটি। এখানকার বালির রং সাদা। আজ আকাশ নীল। তাই সমুদ্রের ছুটে আসা জলের রংও নীল। চমৎকার এই সমুদ্র সৈকত গিনেজ বুকে ওয়ার্ল্ড প্লেজার বিচ নামে স্থান করে নিয়েছে। এর তের মাইল দীর্ঘ মনোমুগ্ধকর বীচের জন্য।
আর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের সেরা দশের তালিকায় এটি আছে সপ্তম স্থানে। যেখানে আমাদের কক্সবাজার আছে দুই নম্বরে। ঘন্টা দুই বীচে কাটিয়ে আমরা ম্যারিল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম।

Romena-Lais 02 Women wordsম্যারিল্যান্ড যেতে নয়নাভিরাম চীজপিক বে ব্রীজ-টানেল; যা তেইশ মাইল দীর্ঘ, পার হলাম। দুই দিকে ব্রীজ আর মাঝে টানেল। নির্মাণশৈলী দেখে মুগ্ধ যুগপৎ বিস্মিত। পুরো যুক্তরাস্ট্রের মধ্যে এটি দ্বিতীয় দীর্ঘতম ব্রীজ।
হর্ণস নামের রেস্টুরেন্টে আমরা যাত্রা বিরতি নিলাম। ইউরো সেমিফাইনালে জার্মানী আর ফ্রান্সের খেলা আর লাঞ্চ দুটোই একসাথে উপভোগ করলাম। ওয়াইফাই সংযোগ করে উত্তেজনাপূর্ণ খেলা উপভোগ করা গেল। সন্ধ্যার আগে পৌঁছলাম কলাম্বিয়ার হ্যাম্পটন বাই হিলটন হোটেলে।

হিলটন হোটেলে নেমেই সাজা সুইমিং পুলে। সুইমিং পুলে একঘন্টা কাটিয়ে রাতে গেলাম সুনামগঞ্জের বারী চাচার ছেলে অপুর বাসায়। সেখানে অপুর বড় ভাই, আমরা কতিপয় তরুণ সাহিত্যসেবীর সাথে সুদর্শন খসরু ভাইও ছিলেন।
পোলাও, তান্দুরী চিকেন, ফিস ফ্রাই, ভেজিটেবল, মাছের টক, শুটকী, সাতকড়া দিয়ে গরুর মাংস। কী নেই মেনুতে! সাতকড়া দিয়ে গরুর মাংস যেন অমৃত। চমৎকার রাঁধে অপুর বউ। সুন্দর সময় কাটলো স্মৃতিচারণে আর ভোজনে।
এরপর বেরিয়ে পরলাম আমরা রাতের ন্যাশনাল হারবার আর হোয়াইট হাউস দেখব বলে। ন্যাশনাল হারবার পোটম্যাক নদীর তীরে। আলেক্জান্দ্রিয়া, মাউন্ট ভারনন আর ওয়াশিংটন ডিসির কেন্দ্রবিন্দুতে। ক্যাপিটল হুইল হলো অন্যতম আকর্ষণ।১৮০ ফিট উচ্চতা থেকে দেখা যাবে হোয়াইট হাউস, ক্যাপিটল হাউস, মনুমেন্ট, সিমেটারি আর পোটম্যাক নদীর সৌন্দর্য। ম্যারিল্যান্ডের এই সৌন্দর্য দেখে চলে গেলাম হোয়াইট হাউস দেখতে। রাতের হোয়াইট হাউসের মায়াবি সৌন্দর্য দেখে ছবি তোলার জন্য আবার দিনের বেলা আসতে হবে ঠিক করা হলো। ফিরলাম হোটেলে।
সকাল আটটার দিকে উঠে ব্রেকফাস্ট টেবিলে টিভি নিউজ দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো। ডালাসে বারোজন পুলিশ আহত নিহত পাঁচ।
Romena-Lais 03 Women wordsপৃথিবী জুড়ে চলছে হানাহানি। ঢাকার গুলশানে ঘটে যাওয়া জঙ্গী হামলায় নিহত বিদেশী আর বাংলাদেশীদের জন্য মন ভারাক্রান্তই ছিলো। জীবন কোথাও থেমে থাকে না। ছুটি-ছাটা সব সময় পাওয়া যায় না। ঈদের দিনেও দেশের সবচেয়ে বড় ঈদ জামাত শোলাকিয়ায় মর্মান্তিক ঘটনায় পুলিশসহ নিহত হন দুইজন। সাথে নিরীহ এক গৃহবধূও মারা যান গুলিতে নিজ বাড়ির নিরাপদ জায়গায় থেকেও।
পৃথিবীতে নিজের বাড়ি মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। কিন্তু সেখানেও আমরা নিরাপদ নই। বিষয়টি আমাকে বিষণ্ন করে তোলে।

হোয়াইট হাউসের সামনে চলে এলাম। ছবি তোলা হল। তারপর ক্যাপিটল হাউস, মনুমেন্ট। আরলিংটনে অবস্থিত পেন্টাগন। যুক্তরাস্ট্রের ডিফেন্স হেড কোয়ার্টার। পেন্টাগন দেখলাম। সবশেষে এয়ার স্পেস মিউজিয়ামে গেলাম। ১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই চাঁদের মাটিতে নীল আর্ম স্ট্রং, এডউইন ই অলড্রিন, মাইকেল কলিন্স যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন তার সব কিছু ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনুভব করলাম। চন্দ্রযান, চন্দ্রপৃষ্ঠে পতাকা হাতে নভোচারী, চাঁদের মাটিতে যে বাহনে তাঁরা ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। চাঁদের মাটি, একখন্ড চাঁদ স্পর্শ করে অন্তরকম শিহরিত হলাম। হারিয়ে গেলাম যেন ১৯৬৯ সালের ২১ জুলাইয়ে। নেভিগেশন এর আধুনিকায়ন আর রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের আবিষ্কৃত প্লেনে…

Romena-Lais 04 Women words

লেখকের আরও লেখা পড়ুন
তাদের ইংরেজি জানার পরিধি, ‘থ্যাংক ইউ’ পর্যন্ত