চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর: সম্পর্কের নতুন দিগন্তে দুই দেশ - Women Words

চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর: সম্পর্কের নতুন দিগন্তে দুই দেশ

রেজা ঘটক

দীর্ঘ ত্রিশ বছর পর (১৯৮৬ সালের পর) চীনের কোনো প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফর করলেন। ‘ওয়ান-বেল্ট, ওয়ান রোড’ নীতির আলোকে চীনের সহযোগিতা সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২২ ঘণ্টার জন্য (১৪-১৫ অক্টোবর ২০১৬) বাংলাদেশ সফর করলেন। নিজ দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষ্যে ৬৫টি দেশকে চীনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে ২০১৩ সালে এই উদ্যোগ নেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনেকগুলো বিনিয়োগ ও আর্থিক সহযোগিতা চুক্তি হয়েছে। এর মধ্যে সরকারী পর্যায়ে ২৭ টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং বেসরকারী পর্যায়েও ১৩ টি চুক্তি হয়েছে। যদিও বাংলাদেশের ও চীনের মধ্যে এখনো ৮৮৫ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই দেশের মধ্যে যে বড় আকারের বাণিজ্য ঘাটতির বিদ্যমান, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরের পর এক্ষেত্রে খুব দ্রুত বড় ধরনের পরিবর্তন না হলেও, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদে বেশ ইতিবাচক ফলাফল পাবে বাংলাদেশ। বিশেষ করে অবকাঠামো খাতে চীনের বিপুল বিনিয়োগ বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াবে। যা আমাদের বিনিয়োগকারীদের প্রতিযোগিতা-সক্ষম মূল্যে পণ্য রপ্তানি করতে সহায়ক হবে। চীনের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাংলাদেশের যেসব চুক্তি হয়েছে সেগুলোর অধিকাংশই রপ্তানিমুখী।

তবে চীনে সরাসরি রপ্তানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাঁধা রুলস অফ অরিজিন বা উৎপাদন দেশ হিসেবে স্বীকৃতির সমস্যা। বর্তমান নিয়মে চীন পণ্যের মোট ৪০ শতাংশ উৎপাদিত হলে তাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ এটিকে কমিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী ২৫ শতাংশ করার অনুরোধ করেছে। পাশাপাশি চীনের বিভিন্ন পণ্য বাংলাদেশে উৎপাদনের বিষয়েও বাংলাদেশ আগ্রহ দেখিয়েছে। উল্লেখ্য, চীনের ব্র্যান্ডেড পণ্য যদি তারা বাংলাদেশে উৎপাদন করে এবং সেটি আমরা চীন, ভারত এবং বিশ্বের যে ৩৯ টা দেশে আমরা শুল্কমুক্ত সুবিধা পাই সেখানে পাঠাতে পারি, তাহলে এটা আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে সহায়ক হবে।

বর্তমানে চীন বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৯০ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান করে। যদিও এসব পণ্যের খুব কমই বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরের সময় আমাদের উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ দিতে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ করার আগ্রহ দেখিয়েছেন।  চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরে চীন বাংলাদেশকে ২৪ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের ঋণ দেয়ার বিষয়ে চুক্তি হয়েছে। যার বেশিরভাগই অবকাঠামো খাতে। বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতের এই বিপুল সহযোগিতা ঠিকমত বাস্তবায়ন হলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি অবশ্যই কমে আসবে। তবে চীন বাংলাদেশকে কি সুদে ঋণ দিচ্ছে, সেখানে কি কি শর্ত দিচ্ছে, সেসব প্রকিউরমেন্টের নীতি বা রিপেমেন্ট পিরিয়ড কেমন, এসব বিষয় এবং চুক্তিগুলো বাংলাদেশে কীভাবে কতটা সময়ের মধ্যে সাশ্রয়ীভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে, তার উপর সেই সুফল পুরোপুরি নির্ভর করবে।

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের রাষ্ট্রপ্রধানের এই সফরকে নতুন যুগের সূচনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছেন, চীন বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার মনে করে। ৮০ সদস্যের যে সরকারি প্রতিনিধিদল নিয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট ঢাকায় এসেছিলেন, সেই দলে ছিলেন চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ছাড়াও কয়েকজন উচ্চপদস্থ মন্ত্রী ও একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল। চীনের প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটিক্যাল ব্যুরোর সদস্য ওয়াং হুনিং, পলিটিক্যাল ব্যুরোর আরেক সদস্য লি ঝানসু, স্টেট কাউন্সিলর ইয়ং জেইছি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই, জাতীয় উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশনমন্ত্রী জু শাওশি, অর্থমন্ত্রী লোও জিউই, বাণিজ্যমন্ত্রী গাও হুচ্যাঙ্গ, মন্ত্রী পর্যায়ের আর্থিক ও অর্থনৈতিক অফিসের পরিচালক লিউ হি, প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের প্রধান ডিং জুইক্সিন, ঢাকায় চীনা রাষ্ট্রদূত মা মিমিংকিয়াঙ্গ, জাতীয় নিরাপত্তা ব্যুরোর মহাপরিচালক ওয়াং সাউজুন এবং সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কং জুয়াইউ।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরে নিজের উদ্যোগে গঠিত বেল্ট ও রোড ইনিশিয়েটিভে বাংলাদেশের যোগদানের লক্ষ্যে একটি কাঠামোগত সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর হয়। এ চুক্তির ফলে চীন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, শ্রীলংকা ও ভারতের মধ্যে মেরিটাইম সিল্ক রোডে যোগদান করল বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর দু’দেশের মধ্যে ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। যার মধ্যে ১২টি ঋণ ও অবকাঠামো চুক্তি, বাকিগুলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে দু’দেশের মধ্যে সহযোগিতার সমঝোতা স্মারক। যেসব খাতে এসব চুক্তি হয়েছে সেগুলো হচ্ছে- বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, ব্লু ইকোনমি, বিসিআইএম-ইসি, সড়ক ও সেতু, রেলওয়ে, বিদ্যুৎ, মেরিটাইম, তথ্যপ্রযুক্তি, শিল্প উন্নয়ন, সামর্থ্য বৃদ্ধি ও সিল্ক উন্নয়ন। এছাড়া উভয় দেশের মধ্যে বেসরকারি খাতে ১৩ বিলিয়ন ডলারের ১৩টি বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

এছাড়া দুই নেতা ছয়টি প্রকল্প উদ্বোধন করেন। প্রকল্পগুলো হলো ১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ইনস্টিটিউট স্থাপন, ২. কর্ণফুলী নদীর নিচে একাধিক লেনের টানেল নির্মাণ, ৩. পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, ৪. চার স্তরের জাতীয় তথ্যভান্ডার, ৫. চট্টগ্রামে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, ৬. শাহজালাল সার কারখানা নির্মাণ প্রকল্প।

চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত উল্লেখযোগ্য সমঝোতা স্মারকগুলো হলো ১. দুর্যোগ মোকাবিলা ও হ্রাসকরণ, ২. সেতু নির্মাণ, ৩. বিনিয়োগ ও উৎপাদন সক্ষমতা সহযোগিতা, ৪. বাংলাদেশ-চীন মুক্তবাণিজ্য চুক্তির সম্ভাব্যতা যাচাই, ৫. সামুদ্রিক সহযোগিতা, ৬. দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, ৭. জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, ৮. জ্বালানি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি সহযোগিতা, ৯. ইনফরমেশন সিল্ক রোড, ১০. তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি সহযোগিতা এবং ১১. সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা সহযোগিতা। এছাড়া স্বাক্ষর হওয়া দুটি রূপরেখা চুক্তি হলো কর্ণফুলী নদীর নিচে একাধিক লেনের টানেল নির্মাণ ও দাশেরকান্দিতে সাগরকেন্দ্রিক ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। এ দুটি চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য চারটি পৃথক ঋণচুক্তিও সম্পাদিত হয়েছে। এ ছাড়া উৎপাদন সক্ষমতা সহযোগিতা চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে।

চীনের প্রেসিডেন্টের সফরের সময় চারটি অর্থনৈতিক চুক্তি স্বক্ষরিত হয়েছে। এগুলো হলো পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, চীনের জন্য বিশেষায়িত অর্থনৈতিক ও শিল্পাঞ্চল, ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে প্রশস্তকরণ প্রকল্প, ব্রডকাস্টিং লাইসেন্স প্রটোকল চুক্তি। এ ছাড়া দ্বিস্তরের পাইপলাইন-সমৃদ্ধ পাওয়ার গ্রিড নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করা এবং ডিপিডিসি এলাকা ও পাঁচটি টেলিভিশন স্টেশনের মধ্যে পাওয়ার সিস্টেম বর্ধিতকরণ চুক্তি।

বাংলাদেশে ইতিপূর্বে সাতটি বড় বড় সেতু এবং একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র নির্মাণ করে দিয়েছে চীন। কিন্তু এবার চীন বাংলাদেশে বড় বড় প্রকল্পে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার চুক্তি করেছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ও চীন সম্পর্কে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের গুরুত্ব যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বাংলাদেশকে বিশ্বের বড় বড় অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশগুলো যে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনা করছে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরে তা আবারো প্রমাণিত হলো। 

রেজা ঘটক: কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা